বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ উন্নয়নের মূল ধারায় আনতে নারীদের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে

258

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
নারীর-ক্ষমতায়ন
উন্নয়নের মূল ধারায় আনতে নারীদের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে
ঢাকা, ৭ ডিসেম্বর, ২০১৯ (বাসস/ইউনিসেফ ফিচার) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে নারীর তাৎপর্যপূর্ণ উন্নয়ন হয়েছে। রাজনীতি থেকে শুরু করে তৃণমূলেও সামাজিকভাবে নারীর ক্ষমতায়ন চোখে পড়ার মতো।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, বিরোধীদলীয় নেতা ও স্পিকার নারী। বাংলাদেশ নারীর রাজনৈতিক ক্ষমতায়নের ক্ষেত্রে অনেক এগিয়েছে। নারীর উন্নয়নের জন্য রাজনৈতিক নেতৃত্বে আরও ক্ষমতায়ন প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ এখন উন্নয়নের মহাসড়কে অবস্থান করছে। এই উন্নয়নের মূল ধারায় নারীদের আনতে তাদের প্রতি আরও মনোযোগী হতে হবে বলেও মনে করেন তারা।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, কর্মক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আগের তুলনায় বেড়েছে। বাংলাদেশে প্রায় ৫ কোটি ৪১ লাখ কর্মজীবী মানুষের মধ্যে ১ কোটি ৬২ লাখ নারী। প্রায় ১৬ হাজার ৭০০ নারী ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প উদ্যোক্তা রয়েছেন। বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা পোশাকশিল্পের শ্রমিকদের ৮০ শতাংশের বেশি নারী।
সুতরাং দেখা যায়, বাংলাদেশ উন্নয়ন ও অংগ্রহণের ক্ষেত্রে অনেক দূর এগিয়েছে। যেহেতু পথটা অনেক লম্বা, এক্ষেত্রে আরও এগিয়ে যেতে হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, কোনো দেশের উন্নয়নের জন্য নারীর উন্নয়ন ও ক্ষমতায়ন একটি চাবিকাঠি। সে জন্য সব ধরনের প্রতিষ্ঠানের এগিয়ে আসা প্রয়োজন।
কর্মক্ষেত্রে নারীদের অংশগ্রহণ বাড়ছে। শ্রমশক্তি জরিপ অনুযায়ী, শ্রমশক্তিতে নারীর অংশগ্রহণ বেড়েছে। যা ২০১০ সালে ছিল ৩৬ শতাংশ। ২০০৫ সালে যা ছিল ২৯ শতাংশ। সুতরাং মোটের ওপরে নারীর অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে।
আর ২২ দশমিক ৩ শতাংশ মানুষ কৃষিক্ষেত্র থেকে তাদের আয় উপার্জন করেন। সেখানে নারীর অংশগ্রহণ পুরুষের চেয়ে ১০ শতাংশ কম।
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ইনস্টিটিউটের পরিচালক ও অধ্যাপক মাহবুবা নাসরীন বলেন, নিয়মিত বেতনে চাকরি ক্ষেত্রে নারী-পুরুষের সমতা আসেনি। নারী কাজ করেও স্বীকৃতি পাচ্ছেন না। নারীদের বড় একটা অংশ অবৈতনিকভাবে কাজ করছেন। অর্থনৈতিক উন্নয়নকে যথাযথভাবে বুঝতে হলে নারীদের অবৈতনিক শ্রমকে হিসাবের মধ্যে আনা জরুরি।
এদিকে বাংলাদেশের রফতানি অন্যতম খাত পোশাকশিল্পে অনেক নারী কাজ করেন। শ্রমিকদের কারণেই পোশাকশিল্প এত দূর এসেছে। পোশাকশিল্পে সরাসরি প্রায় ৪৪ লাখ শ্রমিক কাজ করেন, যার অধিকাংশ নারী। এ শিল্পের সঙ্গে জড়িত নারীর ক্রয় সক্ষমতার কারণে বিভিন্ন ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প টিকে আছে। সুতরাং জিডিপিতে পোশাকশিল্প এবং তার শ্রমিক, বিশেষ করে নারী শ্রমিকদের অনেক বড় অবদান রয়েছে।
তৈরি পোশাক কারখানার মালিক ও রফতানিকারকদের সংগঠন বিজিএমইএ-এর সাবেক সভাপতি মো. সিদ্দিকুর রহমান বলেন, কর্মক্ষেত্রে নারীরা পুরুষের তুলনায় কাজের প্রতি বেশি সৎ থাকেন। নারীরা উপার্জন করছেন। ফলে বিভিন্ন ক্ষেত্রে তাদের সক্ষমতা বৃদ্ধি পেয়েছে। এটা অনেক বড় অর্জন আমাদের।
মহিলা ও শিশু বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের সাবেক প্রতিমন্ত্রী মেহের আফরোজ চুমকি নারী এবং শিশুর উন্নয়নে কাজ করেছেন অনেকদিন ধরে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন বিষয়ে কথা বলেছেন তিনি।
তার মতে, একটি দেশের উন্নয়ন তার মানবসম্পদের উন্নয়নের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। মানবসম্পদ শুধু পুরুষেরা নন, নারীরাও। তাই নারীদের বাদ দিয়ে উন্নয়নের কথা চিন্তা করা বোকার স্বর্গে বাস করা ছাড়া কিছুই নয়। তিনি বলেন, বর্তমান সরকারের নানা উদ্যোগের ফলে উন্নয়নের অগ্রযাত্রায় এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। সেই উন্নয়ন ধরে রাখতে হলে প্রতিটি ক্ষেত্রে নারীর অংশগ্রহণ আরও বাড়াতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বিভিন্ন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানেরও কাজ করার সুযোগ রয়েছে। সাধারণ মানুষকেও সচেতন হতে হবে।
নারী-পুরুষকে দক্ষ মানবসম্পদে রূপান্তরের ওপর জোর দিয়ে মেহের আফরোজ বলেন, সমাজে মেয়ে এবং ছেলেশিশুর মধ্যে কোনো পার্থক্য নেই। সবার শিক্ষা, স্বাস্থ্য, বাসস্থানের পূর্ণ ব্যবস্থা করতে হবে। তার জন্য নারীকে বাড়তি কিছু সুযোগ দিতেই হবে। দীর্ঘদিনের সামাজিক, অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক কাঠামোর কারণে পুরুষেরা অনেক এগিয়ে গেছেন।
তার মতে, একটি মেয়ে যখন কিশোরী বয়সে পা রাখবে, তখন থেকে তার বিশেষ যতেœর প্রয়োজন। শুধু মেয়ের জন্য নয়, আগামী প্রজন্মকে সুরক্ষা দিতে মেয়ের বিশেষ যতœ জরুরি। নারীদের উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে হলে জন্মলগ্ন থেকে নারীর প্রতি মনোযোগী হতে হবে, কিশোরী বয়সে বিশেষ যতœ করতে হবে।
মেয়ে শিক্ষার্থীদের ঝরে পড়া রোধ করতে। একই সঙ্গে তার কারণগুলো চিহ্নিত করে সমাধান করা জরুরি বলেও মনে করেন তিনি।
বাংলাদেশের ক্রীড়া ক্ষেত্রেও নারীরা এগিয়ে গেছে। এখন হরহামেশাই বিশে^ও অনেক দলকে হারিয়ে লাল-সবুজের পতাকা মেলে ধরেন বাংলার বাঘিনীরা। সেটা ক্রিকেট থেকে শুরু করে ফুটবলেও। তবে তা যথেষ্ট নয়। গ্রামাঞ্চলে এখনও মেধাবী তরুণী কিংবা কিশোরীদের ক্রীড়া ক্ষেত্রে সেভাবে অবদান রাখতে পারছেন না।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ জাতীয় নারী ফুটবল দলের সাবেক অধিনায়ক সাবিনা খাতুন বলেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে নারীর খেলাধুলা স্বাভাবিক ছিল না। এখনো খুব একটা স্বাভাবিক নয়। সেখানে ফুটবল খেলা অনেক বড় ব্যাপার। মেয়েদের হাফপ্যান্ট পরে খেলতে দেখলে অনেকে দৃষ্টিকটু মনে করে। সামাজিকভাবে নেতিবাচক কথাবার্তা বলা হয়।
ফুটবলের কথা তুলে ধরে সাবিনা বলেন, ২০০৬ সালে প্রথম বাংলাদেশ জাতীয় নারী দল গঠনের পর বঙ্গবন্ধু জাতীয় স্টেডিয়ামে ভারতের সঙ্গে খেলা হয়। তখন মৌলবাদীরা সেখানে ভাঙচুর করে এবং মেয়েদের ওপর হামলার চেষ্টা করে। যদিও নিরাপত্তা দিয়ে তাদের বের করে আনা হয়। এরপর ২০০৮ সাল পর্যন্ত নারী ফুটবলে তেমন কোনো আসর আয়োজিত হয়নি। ২০০৯ সাল থেকে নারী ফুটবল নতুন উদ্যমে শুরু হয়।
এরপর বাংলার কিশোরীরা বিশে^র বিভিন্ন নামকরা প্রমীলা ফুটবলারদের হারিয়ে জয় ছিনিয়ে এনেছে। ক্রিকেটেও এসেছে সাফল্য।
ফুটবল দলের সাবেক এই অধিনায়ক মনে করেন, নারীর উন্নয়ন ও অংশগ্রহণের জন্য সবার আগে নারীকেই সচেতন হতে হবে। নারীর চিন্তাধারায় পরিবর্তন আসতে হবে। শুধু ঘর-সংসার সামলালে চলবে না। নারীর অগ্রগতির জন্য পরিবারের সহায়তা খুব প্রয়োজন। অনেক সময় সেটা পাওয়া যায় না। তবে সময় বদলে গেছে অনেক। ভবিষ্যতে সেটা আরও এগিয়ে যাবে। এটাই প্রত্যাশা।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/মাহবুব আলম/আহো/১০০০/-কেজিএ