বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : যানবাহনে নারী হয়রানি কমাতে প্রয়োজন সচেতনতা

130

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
যানবাহনে নারী হয়রানি কমাতে প্রয়োজন সচেতনতা
ঢাকা, ২৩ নভেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : প্রবাদ আছে ‘বিশ্বের যা কিছু মহান সৃষ্টি চির কল্যাণকর- অর্ধেক তার করিয়াছে নারী, অর্ধেক তার নর’। অর্থাৎ সেই আদিকাল থেকেই নারী-পুরুষের সম-অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু কখনো কখনো পুরুষ শাসিত সমাজে নারী নিগৃহের কথা শোনা যায়। এখন হার হামেশাই যানবাহনে নারী যাত্রীরা হয়রানির শিকার হচ্ছেন বলে শোনা যায়। যানবাহনে যৌন হয়রানি ছাড়াও ধর্ষণ এমনকি ধর্ষণের পর নারীরা হত্যাকান্ডের শিকার হচ্ছেন নারীরা।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, নারী-পুরুষ সমতা বিধানের জন্য সরকারের নানা উদ্যোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে সরকারের উদ্যোগ থাকলেই হবে না, সাধারণ মানুষের মন মানসিকতার উন্নয়ন প্রয়োজন। দরকার সচেতনতা, সামাজিক আন্দোলন ও আইনের কঠোর প্রয়োগ। তবেই রাস্তাঘাট থেকে শুরু করে যানবাহনে নারী হয়রানি প্রতিরোধ সম্ভব।
পঁয়ত্রিশ বছর বয়সী সালেহা খাতুন, কাজ করেন রাজধানীর একটি বায়িং হাউজে। অফিসের প্রয়োজনে তাকে বিভিন্ন সময় গণপরিবহনে ভ্রমণ করতে হয়। কিন্তু যানবাহনে চড়তে গিয়ে নানা ধরনের বাজে অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হতে হয় তাকে।
বললেন, লেগুনা, বাস কিংবা যেকোনো পরিবহনে চড়ে নিরাপদ বোধ করতে পারি না। রাত কিংবা দিন, কোনো সময়ই কোনো গণপরিবহনে নারীর নিরাপত্তা নেই। পদে পদেই যৌন হেনস্তার শিকার হতে হচ্ছে। এসব সত্ত্বেও বাধ্য হয়ে বিভিন্ন যানবাহনে চড়তে হয়, করবো কী?
সালেহার ভাষ্য, শুধু পাশের সিটে বসা পুরুষ যাত্রী-ই নয়, বাসের চালক, সহকারী-কনডাক্টর নারী যাত্রীদের বিভিন্ন কৌশলে হয়রানি করে থাকে। মাঝে মাঝে মানুষের ভালো ব্যবহারও পাওয়া যায়। তবে এ সংখ্যা খুবই নগণ্য।
শুধু সালেহা-ই নয়, রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন বড় শহর ছাড়াও নানা রুটের যানবাহনে নারীকে পড়তে হয় নানা বিব্রতকর পরিস্থিতিতে। এখন সময় বদলেছে। নারীরা কর্মক্ষেত্রে সাফল্যের স্বাক্ষর রেখে চলেছেন। কারখানা থেকে শুরু করে অফিস আদালত, এমনকি আকাশপথেও বিমান চালান নারীরা। তাই একা একাই তাদের চলাফেরা করতে হয়। আর এ সুযোগটাই নেয় বখাটেরা।
রাজধানীর বাড্ডা এলাকার বাসিন্দা সোনিয়া আক্তার শিলা। পড়াশোনা করছেন ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ে। বললেন, বাড্ডা থেকে মহাখালীতে যেতেই কত যন্ত্রণায় পড়তে হয়। কারণ বাস কিংবা লেগুনায় ওঠা মানেই যৌন হয়রানির শিকার হওয়া। শরীরের স্পর্শকাতর স্থানসহ বিভিন্ন স্থানে হাত দেওয়া, মোবাইলে ফোন করার কৌশল হিসেবে কানের পাশে ফিসফিস করে অশ্লীল কর্থাবার্তা বলতে থাকে একশ্রেণীর বখাটে থেকে মধ্য বয়সী পুরুষ যাত্রীরা।
‘এমন যৌন হেনস্তার শিকার হয়ে কোনো প্রতিকার না পেয়ে আমাদের ভেতরটা দুর্বল, অস্থির হয়ে উঠছে। এমন অবস্থা যখন পরিবহনগুলোয় তখন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, কর্মক্ষেত্র কিংবা পাড়ায়, আমাদের আত্মবিশ্বাসটাই তো কমে যাচ্ছে। এ অবস্থার পরিবর্তন হওয়া প্রয়োজন।’
সরেজমিনে দেখা যায়, রাজধানীর প্রতিটি গণপরিবহনই যাত্রীতে ঠাসা। তিল ধারণের ঠাঁই নেই। এর মাঝেই দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কর্মস্থলে বা গন্তব্যে যাচ্ছেন বিভিন্ন বয়সী নারীরা। দু-চারটি নির্ধারিত নারী সিট থাকলেও তা খুবই অপ্রতুল। আর অফিস সময়ে নারী সিটও চলে যায় পুরুষ যাত্রীদের দখলে। তখন বাসের সহকারী ও কনডাক্টরও নারী যাত্রীদের বাসে তুলে না। সেক্ষেত্রে ঘণ্টার পর ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকতে হয় গণপরিবহনের জন্য।
রাজধানীর সায়েদাবাদ থেকে প্রতিদিনই বাসে করে উত্তরায় একটি বেসরকারি কোম্পানিতে অফিস করেন তাসলিমা আক্তার। ৫ বছর ধরে এ পথে তার যাতায়াত। অভিজ্ঞতার বিষয়ে প্রশ্ন করতেই বলেন, দিন দিন দেশ আধুনিক হচ্ছে, আপডেটেড হচ্ছে মোবাইল ফোনের অ্যাপস। আর পাল্লা দিয়ে বাড়ছে যৌন হেনস্তা। পাশের সিটে বসা পুরুষ যাত্রীটি মুঠোফোনে ইন্টারনেটের সাহায্যে অবাধে অশ্লীল দৃশ্য দেখে উত্ত্যক্ত করার চেষ্টা করে।
‘বাসে উঠতে-নামতেও হেলপার, কনডাক্টরদের দ্বারা যৌন নির্যাতনের শিকার হতে হয়। একেই সঙ্গে বাসের ভেতর, নামতে-উঠতে পুরুষ যাত্রীরাও খুব কৌশলে গায়ে হাত দেয়। কখনও কখনও স্পর্শকাতর স্থানে হাত দেয়। লোকলজ্জায় প্রতিবাদও করতে পারি না।’
গুলশানের একটি পার্লারে কাজ করেন মিরপুরের কালশীতে বসবাসকারী লতা আক্তার। গণপরিবহনে অভিজ্ঞতার কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, রাজধানীর বাসগুলোর অধিকাংশই স্টপেজে পুরোপুরি থামে না। ধীরগতির মধ্যেই বাসে যাত্রী ওঠা-নামা করানো হয়। আর এ সুযোগটিই কাজে লাগায় হেলপার, কনডাক্টর ও কতিপয় কুরুচিসম্পন্ন মানুষ। তারা নারী যাত্রীদের বাসে ওঠা-নামার সময় সহযোগিতার নাম করে গায়ে হাত দেয়, কুদৃষ্টি দেয়। আমি আর নিতে পারছি না। এর পরিবর্তন দরকার।
পল্টনের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করা পাপিয়া জাহান জানান, তার বাসা নতুনবাজার সংলগ্ন নূরের চালায়। এখান থেকেই প্রতিদিন বাসে অফিসে যান। বললেন, সকালে ভিড় পেরিয়ে অফিসে যাই। কিন্তু অবস্থা কাহিল। আর সন্ধ্যা হলেই বুকটা থরথর করতে থাকে। সন্ধ্যার পর বাসে কিংবা ফুটপাতে চলতে গিয়ে যৌন হেনস্তার শিকার হতে হয়।
‘মহিলা সিটে বসা থাকলে পাশে দাঁড়িয়ে থাকা পুরুষ যাত্রীরা বাসের ঝাঁকুনির ছুতোয় বারবার গায়ের ওপর এসে পড়ে। শরীর ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রতিবাদ করলেও কেউ কথা বলে না। উল্টো নারীকেই গালমন্দ করে। বলে বাসে উঠলে এমন নাকি হবেই!’
নারী নির্যাতন প্রতিরোধ জোটের সমন্বয়কারী জিনাত হক বলেন, নারীরা হয়রানির শিকার হয়েও পুলিশের সহায়তা চান না। তাদের ধারণা, পুলিশকে ঘটনা জানালে সমস্যা বাড়তে পারে, তারা বিষয়টিকে হালকাভাবে দেখবে। পরিবারের সদস্যরা নিগৃহীত নারীকেই এসবের জন্য দায়ী করে থাকেন। তাই তারা পরিবারকেও এসব বলেন না।
বেসরকারি সংস্থা অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের পরিচালিত এক গবেষণায় দেখা গেছে, গণপরিবহন যানবাহনে সবচেয়ে বেশি যৌন হয়রানির শিকার হন নারীরা। যানবাহনে ৮৪ শতাংশ নারী সরাসরি যৌন হেনস্তার শিকার হন।
শুধু যানবাহনেই নয়, বাস টার্মিনাল, রেলওয়ে স্টেশন ও লঞ্চঘাটে যৌন হেনস্তার ঘটনা ঘটে বলে গবেষণায় উঠে এসেছে। ভুক্তভোগীদের উদ্ধৃতি দিয়ে গবেষণা প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, জনসমক্ষে যৌন নিগ্রহের শিকার হয়েও নারীরা প্রতিকার হবে না ভেবে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কিংবা পরিবারের সদস্যদের কাছে এসব বলতে চান না। ফলে দিনে দিনে এসব বেড়েই চলেছে। তাই এ সমস্যা সমাধানে চাই ঐক্যবদ্ধ সামাজিক আন্দোলন, পারিবারিক শিক্ষা ও সচেতনতা।
এ বিষয়ে অ্যাকশন এইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ কবীর জানান, নারী ও কন্যাশিশুরা বিভিন্ন যানবাহনে হরহামেশাই যৌন আক্রমণের শিকার হচ্ছেন। নারীদের জন্য নিরাপদ যানবাহন করতে হবে। এক্ষেত্রে সচেতনতা ও আইনের সঠিক প্রয়োগ দরকার।
এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) গণমাধ্যম শাখার উপ-কমিশনার মাসুদুর রহমান এই প্রতিবেদককে বলেন, নারী তথা দেশের প্রতিটি মানুষের নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য আমরা দিন-রাত কাজ করছি। কিন্তু মনে রাখতে হবে পুলিশ কিংবা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর একার পক্ষে কখনই এসব অপরাধ পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আনা সম্ভব নয়।
তিনি বলেন, যানবাহনে নারীর প্রতি হেনস্তা অত্যন্ত দুঃখজনক ও অপরাধমূলক কাজ। নারী নির্যাতন প্রতিরোধে পুলিশ কঠোর অবস্থানে আছে। নারী নির্যাতন রোধে দরকার পারিবারিক শিক্ষা ও সচেতনতামূলক কর্মসূচি।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম খান বলেন, যে হারে যানবাহনে নারীর হয়রানি বাড়ছে। এই সময়ে এসেও নারীদের চলাচলে ভয় নিয়ে ঘর থেকে বের হতে হয়। তাই বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগের।
তিনি আরো বলেন,‘আমরা গবেষণায় দেখেছি, যৌন নিগ্রহের কারণে নারীরা নানা ধরনের মানসিক সমস্যায় ভোগেন। এক পর্যায়ে তারা মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন। পারিবারিক ও সামাজিকভাবে এর প্রতিরোধ গড়ে তুলতে হবে। রুখে দাঁড়াতে হবে সবাইকে। সর্বোপরি সবাইকে সচেতন হতে হবে,’ যোগ করেন তিনি।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/মআ/আহো/১৬২২/স্বব