লক্ষ্মীপুরের রামগতি ও কমলনগরে মেঘনার ভাঙ্গন

398

লক্ষ্মীপুর, ৫ নভেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : জেলার রামগতি ও কমলনগর উপজেলায় মেঘনা নদীর ভাঙন ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। গত ২ মাসের ভাঙনে নদী গর্ভে তলিয়ে গেছে এ দুই উপজেলার শত শত একর ফসলি জমি ও ঐতিহাসিক বহু স্থাপনা। প্রাকৃতিক এ দুর্যোগে ভিটেমাটি হারিয়ে এখন মানবেতর জীবনযাপন করছেন হাজারো মানুষ। ভাঙন কবলিত এলাকায় হাজার হাজার জিও ব্যাগ ফেলেও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ বলছেন, মূল চ্যানেল গুলোতে চর জেগে ওঠায় নদীর পানিতে ভয়ানক ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়েছে। যেকারণে ভাঙন কবলিত এলাকায় সাময়িকভাবে জিও ব্যাগ ফেলেও ভাঙন ঠেকানো যাচ্ছে না। তবে পরিকল্পিতভাবে নদী তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করা গেলে সুফল পাবে উপকূলবাসী। এজন্য ইতোমধ্যে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দাখিল করা হয়েছে বলেও জানা গেছে।
সরেজমিনে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার নদী তীরবর্তী বিভিন্ন এলাকা ঘুরে ভাঙনের ভয়াবহ চিত্র দেখা যায়। গত দুই মাসের ভাঙনে রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার এবং কমলনগর উপজেলার চর ফলকন ইউনিয়নের বিশাল অংশ নদী গর্ভে তলিয়ে গেছে। প্রায় বিলীন হওয়ার পথে বালুরচর, ও সুজন গ্রাম। ঐতিহ্যবাহী লুধূয়া ঈদগাহ্, বাজার, মসজিদ, চর ফলকন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, একটি কমিউনিটি ক্লিনিক গত মাসে নদী গর্ভে হারিয়ে গেছে। ভিটেমাটি হারানো শত শত পরিবারের মানুষ অন্যের জায়গায় এবং লক্ষ্মীপুর-রামগতি আঞ্চলিক সড়কের দুই পাশে মানবেতর জীবনযাপন করছেন। প্রতিদিনই নদী ভাঙছে, আর নদী পাড়ের মানুষ বাস্তুহারা হচ্ছে। তবুও জনপ্রতিনিধিদের আশ্বাস আর সরকারের মহতী প্রচেষ্টায় আস্থা রেখে আশায় বুক বেঁধেছেন তারা।
কমলনগর উপজেলার চর ফলকন ইউনিয়নের বাসিন্দা এ কে এম আবুল বাশার। তিনি চর ফলকন সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রাক্তণ প্রধান শিক্ষক। তিনি বলেন, ‘মেঘনা নদীর অব্যাহত ভাঙনে আমার প্রায় ১০০ একর জমি নদীতে বিলীন হয়ে গেছে। গত ২০ বছরে নদী গর্ভে আমার ৪টি বসতভিটা তলিয়ে গেছে। গত মাসে মাথা গোঁজার শেষ সম্বলটুকু হারিয়ে এখন অন্যের জায়গায় পরিবার-পরিজন নিয়ে খুবই কষ্টে দিন কাটাচ্ছি।
দক্ষিণ চর ফলকন গ্রামের বাসিন্দা সৈয়দ আহম্মদ হাওলাদার বলেন, আমার প্রায় ৭ একর ফসলি জমি নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। নদী ভাঙনের ভয়াবহতায় আমি শঙ্কিত। অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমার বসতভিটা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা করছি।
সম্প্রতি কমলনগর ও রামগতি উপজেলার ভাঙন কবলিত এলাকা ঘুরে ক্ষতিগ্রস্ত মানুষের খোঁজখবর নিয়েছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের কৃষি ও সমবায় বিষয়ক সম্পাদক ফরিদুন্নাহার লাইলী।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, লক্ষ্মীপুর-৪ (রামগতি ও কমলনগর) আসনের সংসদ সদস্য মেজর (অবঃ) আবদুল মান্নান ও বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডের প্রকৌশলী তত্ত্বাবধায়ক (ফেনী সার্কেল) মোহাম্মদ শাহজাহান সিরাজ ভাঙন কবলিত এলাকা গুলো পরিদর্শন করেছেন। ইতোমধ্যে ওইসব এলাকায় ভাঙন ঠেকাতে বালি ভর্তি হাজার হাজার জিও ব্যাগ ভাঙন এলাকায় ফেলা হয়েছে। তবুও ভাঙন ঠেকানো যায়নি।
এদিকে পরিকল্পিতভাবে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের দাবিতে স্থানীয়রা একাধিকবার মানববন্ধনসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন। সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে পরিকল্পিতভাবে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করার দাবি জানিয়েছে তারা। তাছাড়া কোরান খতম দোয়া-মুনাজাতের মাধ্যমেও সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহ তা’য়ালার সাহায্য কামনা করেছেন ধর্মপ্রাণ মুসলমানরা।
চর ফলকন ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হারুনুর রশিদ বলেন, গত ২ মাসে মেঘনার ভাঙনে যে ভয়াবহতা দেখেছি, তা নজীর বিহীন। এবারের ভাঙনে চর ফলকনের বিশাল এলাকা নদী গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। হারিয়ে গেছে বহু ঐতিহাসিক স্থাপনা, মসজিদ, মাদ্রাসা, স্কুল, ক্লিনিক, ফসলি জমি ও দুই শতাধিক পরিবারের বসতভিটা।
লক্ষ্মীপুর পানি উন্নয়ন বোর্ডের ভারপ্রাপ্ত নির্বাহী প্রকৌশলী ফারুক আহমেদ বাসসকে বলেন, মেঘনার মূল চ্যানেল গুলোতে চর জেগে ওঠায় নদীর পানিতে ঘূর্ণি সৃষ্টি হয়ে রামগতি ও কমলনগর উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ভয়াবহ ভাঙন দেখা দিয়েছে। সাময়িকভাবে জিও ব্যাগ ডাম্পিং করেও ক্ষতিগ্রস্ত এলাকায় ভাঙন ঠেকানো সম্ভব হচ্ছে না। এজন্য রামগতি থেকে লক্ষ্মীপুর সদর পর্যন্ত পরিকল্পিতভাবে নদীর তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ জরুরি।
তিনি আরও বলেন, ইতোমধ্যে ৩০.৮১৩ কিলোমিটার তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের জন্য বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ডে একটি উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাব (ডিপিপি) দাখিল করা হয়েছে। প্রকল্পটি একনেকে অনুমোদন পেলে ব্লক ও জিও ব্যাগ দিয়ে স্থায়ীভাবে তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণের কাজ শুরু হবে। সেক্ষেত্রে হয়তো নদী ভাঙন বন্ধ হবে এবং এলাকার মানুষ এর সুফল ভোগ করবে।
উল্লেখ্য, ইতোমধ্যে সরকারি অর্থায়নে মেঘনা নদীর ভাঙন প্রতিরোধ ও উপকূলবাসীর নিরাপত্তার লক্ষ্যে রামগতি উপজেলার আলেকজান্ডার এলাকায় সেনা বাহিনীর তত্ত্বাবধানে সাড়ে ৩ কিলোমিটার এবং কমলনগর উপজেলার মাতাব্বরহাট এলাকায় ১ কিলোমিটার তীর রক্ষা বাঁধ নির্মাণ করেছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান ‘ওয়েস্টার্ন ইঞ্জিনিয়ারিং লিমিটেড’। আরও ১ কিলোমিটার বাঁধ নির্মাণ কাজ চলমান রয়েছে।