বাসস দেশ-৫ : জাতীয় চার নেতাকে হত্যার জন্য আগে থেকেই ঘাতক দল গঠন করা হয়

148

বাসস দেশ-৫
জেলহত্যা-পরিকল্পনা
জাতীয় চার নেতাকে হত্যার জন্য আগে থেকেই ঘাতক দল গঠন করা হয়
ঢাকা, ২ নভেম্বর, ২০১৯ ( বাসস ) : পঁচাত্তরের পনেরই আগস্ট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবারে হত্যার পর পরেই জেল খানায় জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনা করা হয়। পরিকল্পনাটি এমন ভাবে নেয়া হয়েছিল পাল্টা অভ্যুথান ঘটার সাথে সাথে যাতে আপনা আপনি এটি কার্যকর হয়। আর এ কাজের জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি ঘাতক দলও গঠন করা হয় ।
এই ঘাতক দলের প্রতি নির্দেশ ছিল পাল্টা অভ্যুথান ঘটার সাথে সাথে কোন নির্দেশের অপেক্ষায় না থেকে কেন্দ্রীয় কারাগারে গিয়ে তারা জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করবে।
বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রী সভার সবচাইতে ঘৃণিত বিশ্বাসঘাতক সদস্য হিসেবে পরিচিত এবং তৎকালীন স্বঘোষিত রাষ্ট্রপতি খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং বঙ্গবন্ধুর দুই খুনি কর্নেল (অব.) সৈয়দ ফারুক রহমান এবং এবং লে. কর্নেল (অব.) খন্দকার আব্দুর রশীদ এ পরিকল্পনা করেন। এ কাজের জন্য তারা একটি ঘাতক দলও গঠন করে।
এ দলের প্রধান ছিলেন রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন। তিনি ছিলেন ফারুকের সবচেয়ে আস্থাভাজন অফিসার। ১৫ আগস্ট শেখ মনির বাসভবনে যে ঘাতক দলটি হত্যাযঞ্জ চালায় সেই দলটির নেতৃত্ব দিয়েছিল মুসলেহ উদ্দিন।
পঁচাত্তরের পনেরই আগষ্টের নির্মম হত্যাকান্ডের পর তিন মাসেরও কম সময়ের মধ্যে ৩ নভেম্বর মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম বীর সেনানী ও চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দিন আহমেদ, এএইচএম কামারুজ্জামান এবং ক্যাপ্টেন মনসুর আলীকে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের অভ্যন্তরে নির্মমভাবে হত্যা করা হয়। এর আগে খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুথান ঘটান।
দেশের এই চার শ্রেষ্ঠ সন্তানকে কারাগারে ঘাতকরা গুলি এবং পরে বেওনেট দিয়ে খুঁচিয়ে মৃত্যু নিশ্চিত করে। জাতীয় এ চার নেতা মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে পাকিস্তানি সামরিক জান্তার হাতে আটক বঙ্গবন্ধুর অবর্তমানে দেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে নেতৃত্ব দান করেন।
দক্ষিণএশিয়ার প্রথ্যাত সাংবাদিক অ্যান্থনী মাসকারেনহাস তার ‘বাংলাদেশ অ্যা লিগ্যাসি অব ব্লাড’ অথ্যাৎ ‘বাংলাদেশ একটি রক্তাক্ত দলিল’ গ্রন্থে জাতীয় চার নেতাকে হত্যার পরিকল্পনার বিস্তারিত বর্ণনা দিয়েছেন।
১৯৭১ সালে বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ চলাকালীন সময় তিনি বাংলাদেশে সংগঠিত গনহত্যা ও অন্যান্য ঘটনা পর্যবেক্ষন পূর্বক বিশ্ববাসীর কাছে সর্বপ্রথম উন্মোচিত করেন।
মাসকারেনহাস বলেন, রাষ্ট্রপতি হিসেবে শপথ নেয়ার পর মোশতাক তার রাজনৈতিক ক্ষেত্রে সমস্ত সম্ভাব্য প্রতিদ্বন্দ্বীতা সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা গ্রহন করেন। তিনি তার প্রধান প্রতিপক্ষ হিসেবে আওয়ামী লীগকেই বেশি বিবেচনা করতেন। সামরিক বাহিনী নিয়েও তার মাথাব্যাথা ছিল।
মোশতাক যখন দেখলেন মুজিব হত্যার বিষয়টি সহজ হয়ে আসছে , তখনই তিনি তাজ উদ্দিন আহমদ, সৈয়দ নজরুল ইসলাম, মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানের মতো চারজন প্রভাবশালী নেতাকে বন্দি করেন। সানডে টেলিগ্রাফের সাংবাদিক পিটার লিগ তাজউদ্দিনের বন্দিত্ব সচক্ষে দেখেছেন। সামরিক বাহিনীর লোকজন তাঁকে জীপে উঠাচ্ছিলেন তখন পিটার তাজ উদ্দিনকে জিঞ্জাসা করেছিলেন নতুন সরকারে যোগ দিতে যাচ্ছেন কিনা । জবাবে তাজ উদ্দিন বলেন, তাকে সামরিক ক্যাম্পে ডিটেনশনে নেয়া হচ্ছে।
মাসকারেনহাসকে ফারুক পরে জানান , তিনি , রশীদ এবং মোশতাক একটা পাল্টা অভ্যুথান ঠেকানোর জন্য পরিকল্পনা গ্রহন করেন। ফারুক বলেন, শেখ মুজিবকে আমরা যে ভাবে সরিয়েছি , ঠিক একই ভাবে কেউ মোশতাককে সরিয়ে দিতে পারে। পাল্টা অভ্যুথানের এমন সম্ভবনা ছিল তা ধারনা করেই ভাবা হয়েছে , এ ক্ষেত্রে ভারতীয় পৃষ্টপোষকতায় যারা পাল্টা অভ্যুথান ঘটাবে, তাদের প্রথম পছন্দ হবে এই চার নেতা । কাজেই তারা এই নেতাদের সরিয়ে দেয়ার পরিকল্পনা নেন।
তাদের পরিকল্পনাটি ছিল এরকম , যদি পাল্টা অভ্যুথান ঘটে , বা মোশতাককে হত্যা করা হয় , তাহলে দুটি কাজ দ্রুত সারতে হবে। প্রথমত প্রধান বিচারপতি আবু সাদাত মোহাম্মদ সায়েমকে সাথে সাথে রাষ্ট্রপতি হিসাবে নিয়োগ করা , যাতে রাষ্ট্র পরিচালনায় কোন শূন্যতা সৃষ্টি না হয় ।
একই সাথে একই সময় এক দল যাবে সেন্ট্রালজেলে । সেখানে তাজ উদ্দিন আহমদ , সৈয়দ নজরুল ইসলাম , মনসুর আলী এবং কামরুজ্জামানকে হত্যা করা হবে। এ কাজের জন্য পাঁচ সদস্য বিশিষ্ট একটি ঘাতক দলও গঠন করা হয়। যারা ছিল এই বিষয়ে বিশেষ ভাবে প্রশিক্ষন প্রাপ্ত। ফারুকের সবচেয়ে আস্থাভাজন অফিসার রিসালদার মুসলেহ উদ্দিন কে এ দলের প্রধান করা হয় ।
ফারুক বলেন, এ পরিকল্পনাটি এমন ভাবে করা হয়েছে , যাতে পাল্টা অভ্যুথান ঘটার সাথে সাথে এ প্লানটি আপনা – আপনি কার্যকর হয়ে যায় ।
পচাঁত্তরের ৩ নভেম্বর খালেদ মোশাররফ পাল্টা অভ্যুথান ঘটানোর পরেই কেন্দ্রীয় কারাগারে এই জাতীয় চার নেতাকে হত্যা করা হয় ।
এর আগে পঁচাত্তরের ৩ অক্টোবর খোন্দকার মোশতাক টিভি ও রেডিও ভাষনে ঘোষনা দেন যে , জনগনের গনতান্ত্রিক অধিকার ফিরিয়ে দেয়ার লক্ষ্যে ১৯৭৬ সালের ১৫ আগস্ট রাজনৈতিক তৎপরতার উপর সমস্ত নিষেধাঞ্জা তুলে দেয়া হবে এবং সংসদীয় সরকার গঠন করা হবে। একই ভাবে সকল রাজবন্দিদের মুক্তি দেয়া হবে বলেও ঘোষনা দেন তিনি । কিন্তু মোশতাক এটি সত্য বলেননি। অন্তত চার নেতার মুক্তির ব্যাপারে তিনি কোন প্রচেষ্টাই গ্রহন করেন নি।
গোলাম মুরশিদ তার ‘মুক্তিযুদ্ধ ও তারপর ’ গ্রন্থে লিখেছেন মোশতাক জেল হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন কেবল ফারুক আর রশিদকে নিয়ে । তিনি ঠিক করেছিলেন যে, যে কোন পাল্টা অভ্যুথান হলে কেন্দ্রিয় কারাগারে আটক তাজউদ্দিন আহমদ , সৈয়দ নজরুল ইসলাম ,মনসুর আলী এবং কামারুজ্জামানকে হত্যা করা হবে। যাতে নতুন সরকার গঠিত হলেও এই নেতারা তাতে নেতৃত্ব দিতে না পারেন।
বাসস/কেসি/১৫৪০/-আসাচৌ