বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : দেশে ফ্যাশন স্টুডিও করার স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা সামিয়া

122

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
দেশে ফ্যাশন স্টুডিও করার স্বপ্ন দেখেন উদ্যোক্তা সামিয়া
॥ তাসলিমা সুলতানা পপি ॥
ঢাকা, ১৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : ‘ছোটবেলা থেকেই শুনে আসছি ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, শিক্ষক বা ব্যাংকারের ক্যারিয়ার গড়তে হবে। কিন্তু এসবের কিছুই আমার ভালো লাগতো না। আমি চাইতাম, নিজে কিছু করবো। যেখানে আমি-ই সব।’
শুরুটা এভাবেই করলেন সামিয়া ফারাহ। ডাক নাম শাওন। বাবা সরকারি কর্মকর্তা। তিনি পরিবারের বড় সন্তান। তারা দুই বোন। সন্তানদের নিয়ে বাবা-মায়ের স্বপ্ন-আশা একটু বেশিই ছিল বোধহয়।
সব মিলিয়ে মমতাময়ী মায়ের সংসারে দুই বোনকে ঘিরে জীবনের গল্পটাও যেন ছিল রূপকথার মতো সাজানো। সময় বয়ে চলে আপন গতিতে। এর মাঝেই তৈরি হতে থাকে জীবনের উত্থান-পতনের গল্প।
জীবনের এই গল্পে সফল এক ব্যক্তিত্ব সামিয়া ফারাহ। নিজেকে নিজেই গড়ে নিয়েছেন। এখন বিশ্বের ১১টি দেশে তার ডিজাইন করা পোশাক অনলাইনে বিক্রি হয়। গ্রাহকদের মাঝে নিজস্ব একটি আলাদা জায়গা করে নিয়েছে সামিয়া ফারাহর পোশাক বিক্রির অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ‘ফারাহ্স ওয়ার্ল্ড’।
সম্প্রতি সামিয়া ‘ফারাহ্্স ওয়ার্ল্ডে’র সফলতার পেছনের গল্প শোনালেন। তিনি বলেন, ছোটবেলা থেকেই পরিবারের চাপ ছিল ক্যারিয়ার নিয়ে ভাবার। অর্থনীতিতে অনার্স-মাস্টার্স করলাম। মাস্টার্স পরীক্ষার রেজাল্ট তখনও হয়নি। ধানমন্ডিতে একটি ইংলিশ মিডিয়াম স্কুলের শিক্ষক হিসেবে জয়েন করলাম। সঙ্গে চললো সরকারি চাকরির প্রস্তুতির পড়াশোনা। এর মধ্যে বিয়েও হয়ে গেল। পাত্র মাল্টি ন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করেন। এই পর্যায়ে ধানমন্ডিতে স্কুলের চাকরিটা আমি ছেড়ে দিই।
চাকরি-বাকরি ছেড়ে সামিয়া মন দেন পরিবার সামলানোর কাজে। কিছুদিন পর চাকরি পান স্ট্যান্ডার্ড চ্যাটার্ড ব্যাংকে। তার ভাষায়, খুব শখ ছিল মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানিতে চাকরি করার। অফিসও ছিল বাসার কাছেই, বনানীতে। এর মধ্যে নিজের ভেতর ছেলের অস্তিত্ব টের পাই। তাই শখ থাকা সত্ত্বেও চাকরি বেশিদিন করতে পারিনি। তখন খুব মন খারাপও হয়েছিল। কিন্তু সন্তানের কথা ভেবে নিজেকে সান্ত¦না দিলাম, যোগ করেন এই নারী উদ্যোক্তা।
চাকরি ছেড়ে দেওয়ার কষ্ট মনের গহিনে পুষতে থাকলেও পরে ছেলের জন্যই নিজের সবটুকু সময় বরাদ্দ রাখেন সামিয়া। স্বামী ব্যস্ত মানুষ। তাই তিনিও সেভাবে সময় পান না। সামিয়ার ভাষ্য, ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত থাকলেও এক ধরনের বিষণœতায় ভুগতাম তখন। খুব খারাপ সময় গেছে। আমার অবস্থা বুঝতে পারলো একমাত্র ছোটবোন। সে-ই পরামর্শ দিল ডিজাইন নিয়ে কাজ করতে।
আমি নিজেও অবশ্য ছোটবেলা থেকেই ফ্যাশনসচেতন ছিলাম। কখনো রেডিমেড কাপড় পরতে চাইতাম না। চাঁদনী চক থেকে নিজে গজ কাপড় কিনে নানা রকম ডিজাইন করে ড্রেস বানাতাম। আমার জামা অন্য কারো সঙ্গে মিলে যাবে, এটা হতেই পারে না! সেটা অবশ্যই হতে হবে ইউনিক।
ছোটবোনের পরামর্শে নেমে পড়লেন কিছু একটা করার কাজে। কিন্তু তখনও ভাবেননি আদৌ তিনি কী করবেন? শোনা যাক সামিয়ার মুখেইÑ
বোনের পরামর্শেই ডায়েরিতে ডিজাইনের স্কেচিং শুরু করলাম। আমার অনেক শখের মধ্যে একটা ছিল পত্রিকা জমানো। দেশ-বিদেশের নানান রকমের ম্যাগাজিন। আইডিয়া খুঁজে পাওয়ার ব্যাপারে সেগুলো খুব কাজে দিল। নিজের জমানো মাত্র পাঁচ হাজার টাকা দিয়ে শুরু করলাম ব্যবসা।
বললেন, মায়ের কাছে ছেলেকে রেখে লোকাল মার্কেট ঘুরে ঘুরে কিছু কাপড় কিনলাম। খুঁজে খুঁজে বের করলাম অভিজ্ঞ কারিগর। বেশ কিছু ড্রেসও বানালাম। শুরুতে পরিবার এবং বন্ধুদের মাঝে খুব ভালো সাড়া পেলাম। জামাগুলো বিক্রিও হয়ে গেল দ্রুত। যা আমায় বেশ উৎসাহ দেয়।
তৃপ্ত হাসিমাখা কণ্ঠে তিনি বলেন, ভাবলাম ডিজাইনিং-এ যেহেতু কোনো প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেই আমার, একটা ডিপ্লোমা কোর্স করলে কেমন হয়? যেই ভাবা, সেই কাজ। ভর্তি হয়ে গেলাম ধানমন্ডির রেডিয়েন্ট ফ্যাশন ইনস্টিটিউটে। প্রথমে ভালো করলেও কোর্সটি আর শেষ করা হয়ে ওঠেনি।
এফ-কমার্সের শুরুর দিকের কথা তুলে ধরে সামিয়া বলেন, ২০১১ সালে আমার ছোটবোনই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের প্ল্যাটফর্ম ফেসবুকে একটা পেজ খুলে দেয়। তার আগে পর্যন্ত সব পরিচিত মানুষেরা আমার ক্লায়েন্ট ছিলেন। পেজ খোলার পর আস্তে ধীরে ক্লায়েন্টের সংখ্যা বাড়লো। এর পরই মূলত ব্যবসা বড় হতে থাকে। দেশের বাইরে থেকেও প্রচুর অর্ডার পেতে শুরু করলাম। কিন্তু আমার এই ব্যস্ততা অনেকের ভালো লাগেনি। সেটা পরিচিতজন এবং কাছের লোকজনদেরই মধ্যে। স্বামী সুপ্রতিষ্ঠিত। এরপরও আমি কেন ব্যবসা করবো? ইত্যাদি কথাবার্তা।
তিনি বলেন, তবে আমি আমার জায়গায় শক্ত। আমিও একটা মানুষ। আমারও আপন আইডেন্টিটি দরকার। আমার মধ্যে সৃষ্টিশীলতা রয়েছে। সুতরাং আমি কেন বসে থাকবো? আর যেখানে শুধু কাপড় কালেকশন বাদে বাকি সব কাজই আমি বাসায় বসেই করতে পারছি। সংসারকে প্রায়োরিটি দিয়েই সব কাজ করছিলাম। কিছুদিন পর বাসার নিচে একটা শোরুম দিলাম। সহযোগী হিসেবে একজন মেয়ে রাখলাম। সবকিছু বেশ ভালোই চলছিল। কিন্তু মাঝে আমার স্বামীর চাকরি চলে যায়। অনেক ঋণ হয়ে গেল তার। এক পর্যায়ে পারিবারিক অশান্তি শুরু হয়। তখন বাধ্য হয়ে বিয়ে বিচ্ছেদ ঘটে। শুরু হয় নতুন অধ্যায়, নতুন সংগ্রাম।
সামিয়া বলে চলেন, ছেলেটাকে নিয়ে একা চলার যুদ্ধ শুরু হলো। প্রথমে চাকরির চেষ্টা করলাম। কিন্তু ততদিনে অনেক গ্যাপ হয়ে গেছে। নতুন করে ব্যবসা শুরু করতে হলো তাই। এবার আর শখ করে নয়। এই পর্যায়ে আমি আরও বেশি সিরিয়াস, আরও বেশি ম্যাচিউরড। সেইসঙ্গে আর অনেক বেশি প্রফেশনাল। আমার ব্যবসার মূলধন ছিল সততা ও ভালো ব্যবহার। দ্রুত ক্লায়েন্ট বাড়তে লাগলো। পুরোনো ক্লায়েন্টরাও যোগাযোগ শুরু করলেন। এরপর আমাকে আর পেছনে তাকাতে হয়নি।
অনলাইনে ব্যবসার প্রসার প্রসঙ্গে তিনি বলেন, কাপড়ের মান নিয়ে কখনই কম্প্রোমাইজ করিনি। আর আমি বরাবরই আফটার সেল সার্ভিসকে গুরুত্ব দিই। একজন কাস্টমার কাপড় কিনলেন, টাকা পেয়ে গেলাম, সেখানেই শেষ নয়। আমি প্রতিনিয়ত তাদের ভালো-মন্দ বিষয়গুলো দেখভাল করি। এরই ধারাবাহিকতায় ‘Farah’s World’ এখন একটা সুপরিচিত এবং বিশ্বাসযোগ্য ফেসবুক পেজ। বাংলাদেশসহ ১১টি দেশে আমার ডিজাইন করা পোশাক যাচ্ছে।
ভবিষ্যৎ ভাবনা ও পরিকল্পনা কি? এ প্রশ্নের উত্তরে উদ্যোক্তা সামিয়া ফারাহ বলেন, একদিন একটা ফ্যাশন স্টুডিও হবে আমার, সেই স্বপ্ন-ই দেখি। আর, সেটা দেশে একদিন আমি-ই প্রতিষ্ঠা করবো, ইনশা আল্লাহ।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/তাসু/হাহা/১৭১৮/আহো/-এসএইচ