বাজিস-১ : পিরোজপুর শহরের পিচঢালা পথে আলপনা এঁকেছিল ভাগিরথীর তাজা রক্ত

249

বাজিস-১
পিরোজপুর-ভাগিরথীর রক্ত
পিরোজপুর শহরের পিচঢালা পথে আলপনা এঁকেছিল ভাগিরথীর তাজা রক্ত
পিরোজপুর, ১২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : ১৯৭১ সালে মহান মুক্তিযুদ্ধে জন্মভূমির স্বাধীনতা অর্জনে অবৈধ দখলদার হানাদারদের বিতাড়িত করতে নিজের জীবন উৎসর্গ করেছেন পিরোজপুর এক নিভৃত গ্রামের গৃহবধূ ভাগীরথী সাহা। দিনটি ছিল ১৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১। পিরোজপুর শহরের পিচঢালা পথে আলপনা এঁকেছিল ভাগিরথীর তাজা রক্ত।
১৯৪০ সালে বাগেরহাটের কচুয়া উপজেলার দেবীপুর গ্রামের মুড়ি বিক্রেতা বসন্ত সাহার ঘরে ভাগীরথীর জন্ম। আর্থিক কারণে বাড়িতে অক্ষর জ্ঞান অর্জন ছাড়া লেখাপড়ার সুযোগ হয়নি তার। বিয়ে হয় ষোল বছর বয়সে। স্বামী প্রিয়নাথ সাহার বয়স তখন চল্লিশ। তাঁর বাড়ি পিরোজপুর সদর উপজেলার বাগমারায়। তাঁদের ঘরে জন্ম নেয় দুই ছেলে । ১৯৬৭ সালে প্রিয়নাথ সাহা মারা গেলে অসহায় হয়ে পড়েন ভাগীরথী। অনেক কষ্টে ছেলেদের মুখে অন্ন তুলে দেয়ার চেষ্টা করেন তিনি। একাত্তরের ৪ মে ৩২ পাঞ্জাবের এক প্লাটুন রক্তপিপাসু হায়নারা পিরোজপুরের কয়েকশ নিরীহ মানুষকে নির্মমভাবে হত্যা করে, বাড়ি ঘর পুড়িয়ে দেয়। রাজাকার আলবদর জামায়েত ও মুসলিমলীগের সমর্থকদের সহযোগিতায় খানসেনারা বাগমারা গ্রামের সব কয়টি বাড়ির মালামাল লুট করে নিয়ে যায়। দুই ছেলেকে নিয়ে আবার মহাবিপদে পড়ে যান ভাগীরথী। উপায়ন্তর না দেখে পিরোজপুরে শহরে বাসা বাড়িতে ঝিয়ের কাজ নেন। প্রতিদিন সকালে তিনি নৌকায় পিরোজপুর শহরে এসে বিভিন্ন বাসায় কাজ করেন। নৌকায় চড়ে প্রতিদিন যাওয়া-আসার সময় তাঁর চোখে পড়ে নদীতে ভাসমান মানুষের লাশ। নদীর পাড়ে শিয়াল শকুনের ভক্ষণরত লাশ দেখতে পান তিনি। এসব দেখতে দেখতে পাকিস্তানীদের প্রতি তার তীব্র ক্ষোভ জন্মে। এক সময় তাঁর মনে জ্বলে উঠে প্রতিশোধের অগ্নিশিখা। সেই সময় বাগমারাসহ আশপাশের গ্রামগুলোতে মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বাড়তে শুরু করেছে। ১৩ আগষ্ট৭১ এ সরোয়ার হোসেনের নেতৃত্বে ১৭ জন মুক্তিযোদ্ধা একপাই জুজখোলা গ্রামে অবস্থান নেন। পরে মতিউর রহমান সরদারের নেতৃত্বাধীন আরেকটি দল সরোয়ারের সংগে মিলিত হয়ে খানসেনাদের দোসর রাজাকার কমান্ডার আবদুল আলীর উপর আক্রমণ চালায় এবং তাকে কঠোর শাস্তি দেয়া হয়। তাঁদের কাছে ভাগীরথী যুদ্ধে অংশ নেয়ার আগ্রহ দেখান। তাঁকে দায়িত্ব দেয়া হয় পাকিস্তানী হানদারও তাদের দোসরদের গতিবিধির উপর নজর রাখার। মুক্তিযোদ্ধাদের চর হিসেবে দায়িত্ব পেয়ে ভাগীরথী পিরোজপুর শহরে এসে পাক দখলদারদের ক্যাম্পের সামনে গিয়ে ভিক্ষুকের বেশ ধরেন। তাঁকে দেখে পাকিস্তানী সুবেদার সেলিম ভাগীরথীকে প্রস্তাব দেয় মুক্তিযোদ্ধাদের অবস্থান সম্পর্কে গোপনে তথ্য দেয়ার। ভাগীরথী তার প্রস্তাবে সম্মত হন। তবে সেসব কেবল তাদের বিভ্রান্ত করার জন্যই। ওদিকে মুক্তিযোদ্ধাদের প্রস্তুত রেখে ২৯ আগষ্ট বাগমারায় খানসেনাদের সেখানে নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেন। ভাগীরথীর তথ্যানুযায়ী তারা সেখানে যায় এবং মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের শিকার হয়। ৮ ও ৯ সেপ্টেম্বর আবারও ভাগীরথীর দেয়া তথ্যে বাগমারা পোরগোলাসহ আশপাশের গ্রামে যায় তারা। কিন্তু সেখানে গিয়ে খানসেনারা বুঝতে পারে তারা পাতানো ফাঁদে পড়েছে। মুক্তিযোদ্ধাদের অতর্কিত আক্রমণে বেশ কয়েকজন পাকিস্তানী হতাহত হয়। ফেরার পথে প্রতিশোধ হিসেবে নিরীহ মানুষকে গুলি করে হত্যা করে তারা।
ক্যাম্পে ফিরে ক্যাম্প প্রধান ক্যাপ্টেন এজাজকে সব জানানো হলে এজাজ নিশ্চিত হয় ভাগীরথী প্রকৃতপক্ষে তাদের চর নয়, সে মুক্তিযোদ্ধাদের চর। ভাগীরথীকে হত্যা করার নির্দেশ দেয় এজাজ। ১৩ সেপ্টেম্বর ভাগীরথী পিরোজপুর শহরে এসে পাকিস্তানী বর্বর বাহিনীর গতিবিধি ও তাদের খোঁজখবর নিতে থাকেন। তার শহরে ঢোকার খবর পৌঁছে যায় ক্যাম্পে। তাকে ধরে ফেলে রাজাকাররা টেনেহিচড়ে নিয়ে যায় ক্যাপ্টেন এজাজের সামনে। সুবেদার সেলিমকে নির্দেশ দেয়া হয় সবার সামনে ভাগীরথীকে হত্যা করার। এ নির্দেশ পাওয়ার পর দু’জন সিপাহি রশি দিয়ে ভাগীরথীর দুই হাত বেঁধে তাঁকে মাটিতে ফেলে দেয়। রশির অপর প্রান্ত মোটর সাইকেলের সঙ্গে বেঁধে দেয়া হয়। সুবেদার সেলিম মোটর সাইকেল চালিয়ে শহরের বিভিন্ন সড়কে ভাগীরথীকে টেনে তাকে করে রক্তাক্ত, রঞ্জিত করে শহরের পিচঢালা পথ। এক সময় ভাগীরথী প্রাণহীন হয়ে পড়েন। পরে তাঁর নিথর দেহটি নিক্ষেপ করা হয় বলেশ্বর নদে। পিরোজপুরের সাংবাদিক খালিদ আবু বলেন, আমি স্বচক্ষে পোষ্ট অফিস রোড থেকে ভাগিরথীকে টেনে নিয়ে যাওয়ার দৃশ্য দেখেছি। দেখেছি ভাগিরথীর রক্তাক্ত সাদা শাড়ী আর রাস্তায় রক্তের ছোপ। যুদ্ধাহত মুক্তিযোদ্ধা ও যুদ্ধকালীন কমান্ডার বর্তমানে পিরোজপুর সদর উপজেলা আওয়ামীলীগের সভাপতি মতিউর রহমান সরদার জানান, ভাগিরথীর উপর অর্পিত দায়িত্ব সে অত্যন্ত নিষ্ঠার সাথে পালন করেছে। তাকে যেভাবে শহরের রাস্তায় টেনে হত্যা করা হয়েছে তা একমাত্র পশুদের পক্ষেই সম্ভব। পাকিস্তানী নরপশুরা তাই করেছে।
সাগর তীরের জেলা পিরোজপুরের খর¯্রােতা বলেশ্বরের উত্তাল ঢেউ আর তীব্র ¯্রােতে ভাগীরথীর নিস্প্রাণ দেহটি ভেসে যায় সাগরে। দু’টি অবুঝ শিশু সন্তান আর আত্মীয় স্বজনরা শেষবারের মত দেখতে পায়নি তাদের প্রিয়জন এ বীর নারীর মুখটি।
বাসস/সংবাদদাতা/১১-৩০/নূসী