বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : তামাক গ্রহণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা

132

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
তামাক গ্রহণে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে শিশুরা
ঢাকা, ২ সেপ্টেম্বর, ২০১৯ (বাসস) : রাজধানীর ফার্মগেট এলাকায় ভাসমান বাসিন্দা গফুর (১৩) ও রায়হান (১৫)। এরা ধূমপায়ী। দৈনিক গড়ে ১০টা করে বিড়ি পান করে। রায়হান জানায়, সারাদিন হেলপারির কাম করি, বিড়ি না খাইলে কাম কাজে এনার্জি পাইনা।’
গফুর জানায়, ‘সিগারেট বা বিড়ি ফুঁকলে নিজেরে বড় মানুষের মত দেহায়। ইনকাম কইরা যেহেতু মা-বইনের ভাত কাপড়ের ব্যবস্থা করি তহনতো বড়ই হইছি। পুরুষ মানুষের আবার বয়স কি?’
এসব শিশুরা ধুমপান করে যে শুধু নিজের ক্ষতি করছে তা নয়। তাদের চারপাশে থাকা পরোক্ষ ধুমপায়ীরাও নানা ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। ধুমপানের গবেষণায় দেখা যায়, বয়সে বড় ধুমপায়ীদের তুলনায় শিশুরা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বিভিন্ন রোগের কারণে বছরে প্রায় ১ লাখ ৬৫ হাজার শিশুর মৃত্যু হচ্ছে। এরমধ্যে দুই-তৃতীয়াংশ শিশুর মৃত্যু হচ্ছে আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ায়। শিশুদের বড় একটা অংশ ঘরে নিকটজনের পরোক্ষভাবে ধূমপানের শিকার হয় এবং এদের নানা ধরনের রোগ সংক্রমণের ঝুঁকি বেড়ে যায়। গ্লোবাল ইউথ ট্যোবাকো সার্ভে (জিওয়াইটিএস) ২০১৩ সালের তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে তামাক আসক্তি একটি উদ্বেগজনক বিষয়। ১৩ থেকে ১৫ বছর বয়সের প্রায় ৭ শতাংশ কিশোর-কিশোরী তামাক পণ্য ব্যবহার করে থাকে।
অন্যদিকে এক গবেষণায় ১১৫টি দেশের তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, বয়:সন্ধিকালের ছেলে এবং মেয়ের মধ্যে ধূমপানের হার বেড়েছে। তথ্যসূত্রে শতকরা ১২ শতাংশ ছেলে এবং ৭ শতাংশ মেয়ে ধূমপান করেছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন,ধূমপায়ী পুরুষ,নারী বা শিশু যেই হোক না কেন তারা পারিবারিক ও ঘরের বাইরে খোলা স্থানে এবং অফিস আদালতে প্রকাশ্যে ধূমপান করার কারণে আশেপাশে থাকা অধূমপায়ীদের ক্ষতি করে থাকেন তাদের অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে। দেশের প্রায় ২ কোটিরও বেশি মানুষ ধূমপান করছে। দেশের মোট জিডিপির এক শতাংশ ব্যয় হচ্ছে কেবল ধূমপানের পেছনে। এরমধ্যে ১৫ বছর ও তার বেশি বয়সীদের মধ্যে তামাক গ্রহণের প্রবণতা বেশি। গ্লোবাল অ্যাডাল্ট টোব্যাকো সার্ভ (গ্যাটস) বাংলাদেশ প্রতিবেদন ২০০৯ এ এসব তথ্য উঠে এসেছে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা (হু), ইউএস সেন্টার ফর ডিজিজ কন্ট্রোল অ্যান্ড প্রিভেনশন (সিডিসি) ও নিপসমের যৌথ উদ্যোগে প্রতিবেদনটি প্রকাশিত হয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়,দেশের ১৫ বছর ও তার অধিক বয়সীদের ৪৩ দশমিক ৩ শতাংশই তামাকে আসক্ত। এতে বলা হয়, কোন প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা নেয়নি এমন জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬৩ শতাংশ তামাক গ্রহণ করে। এই হার মাধ্যমিক পর্যায়ে বা তার চেয়ে বেশি শিক্ষিতদের তিনগুণ। তামাক গ্রহণকারীদের ১৮ দশমিক ৫ শতাংশ ১৫ বছরের কম বয়সে তামাক গ্রহণ করে, এসব মানুষের ২৫ শতাংশ ১৫ থেকে ১৬ বছরের শিশু তামাক গ্রহণ করা শুরু করে।
সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের পরিচালক ডা. উত্তমকুমার বড়–য়া বলেন,তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে হবে। না হলে ধূমপানের কারণে অকাল মৃত্যু হতে পাবেনা অনেক ধূমপায়ী।
বিশ্বের প্রায় ১৫১ টি দেশের তথ্য নিয়ে দেখা গেছে, বয়:সন্ধিকালে ছেলে এবং মেয়েদের মধ্যে ধূমপানের হার বেড়েছে। শতকরা তামাক গ্রহণ থেকে বিরত রাখতে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কাজ করছে অনেক সংস্থা। দীর্ঘদিনের আন্দোলনের ফসল হিসেবে বাংলাদেশে ২০১৬ সালের ১৯ মার্চ থেকে প্রতিটি সিগারেটের প্যাকেটে স্বাস্থ্য সতর্কবাণী দেখা যাচ্ছে। তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহারের কারণে সৃষ্ট ক্ষতি সম্পর্কিত রঙিন ছবি ও লেখা সম্বলিত সতর্কবার্তাকে সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবাণী হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে।
এর মধ্যে ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস উপলক্ষে প্রথমবারের মতো বাংলাদেশ ক্যান্সার ও তামাকবিরোধী জোটের উদ্যোগে ১০টি সংগঠন নিয়ে যাত্রা শুরু করেছে। আগামী দিনে তামাক ও ক্যান্সার নিয়ন্ত্রণে এই জোট জোরালো ভূমিকা রাখবে বলে জানান জাতীয় ক্যান্সার ইপিডিমিওলজি বিভাগের প্রধান ডা. হাবিবুল্লাহ তালুকদার রাসকিন।
তিনি বলেন, বিশ্বজুড়ে ২৪ ঘন্টা সময়সীমা ধরে তামাক সেবনের সকল প্রক্রিয়া থেকে বিরত থাকতে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে প্রতিবছর ৩১ মে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস পালন করা হয়। আলোচনা করা হয় এর কুফল ও স্বাস্থ্যের নেতিবাচক প্রভাবের বিষয়ে। আসলে ধুমপান ছাড়তে প্রয়োজন ইচ্ছাশক্তি। নিজ উদ্যোগই পারে একজন ব্যক্তিকে তামাকমুক্ত করতে।এতে নিজের স্বাস্থ্যসহ পরিবার ও সমাজের উপকার হয়। আমরা যৌথভাবে যে জোট গঠন করিছি তার মাধ্যমে সমাজের নানাস্তরে তামাকবিরোধী ক্যাম্পেইন চালাবো।
তিনি বলেন,তামক সেবনে ফুসফুসে ক্যান্সার, স্ট্রোক, সিওপিডি, হাইপার টেনশন, পেরিফেরাল ভাসকুলার ডিজিজ, এবং গর্ভাবস্থায় ধুমপান মা ও শিশু ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। বিশেষজ্ঞদের মতে প্রতিবছর বিশ্বে ৬০ লাখ মানুষ তামাকজাত ধুমপানের কারণে মৃত্যুবরণ করে। এরমধ্যে ৬ লাখ অধুমপায়ী ধুমপানের পরোক্ষ ধোঁয়ার কারণে মৃত্যুবরণ করে। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিউএইচও) সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ১৯৮৭ সালে বিশ্ব তামাকমুক্ত দিবস চালু করে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডাব্লিউএইচও) গত ২৬ জুলাইয়ে প্রকাশিত বৈশ্বিক প্রতিবেদনে জানা যায়, বাংলাদেশের আসক্ত ব্যক্তিদের ৭০ শতাংশই ধূমপান ছাড়তে চায়। জাতিসংঘ বলেছে, তামাকজাত পণ্যের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে অগ্রগতি হয়েছে। তবে প্রাণঘাতী তামাক পণ্যের ব্যবহার ছাড়তে জনগণকে সহযোগিতা করার জন্য আরো বড় পরিসরে উদ্যোগ নেয়া দরকার।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/সাহো/-আসচৌ/১৬২০/আহো/-এসএইচ