বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের বিকল্প নেই

267

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে-প্রাতিষ্ঠানিক প্রসব
নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিতে প্রাতিষ্ঠানিক প্রসবের বিকল্প নেই
ঢাকা, ২৭ আগস্ট, ২০১৯ (বাসস) : শুরু থেকেই নানা অবহেলায় শ্বশুর বাড়িতে দিন নাবিলার (ছদ্মনাম) কাটছিল। গর্ভবতী হলে তারা চিকিৎসকের কাছে যেতে নিরুৎসাহিত করে। ফলে আট মাসের গর্ভাবস্থায় প্রসব বেদনা শুরু হলে শ্বশুরবাড়ির মুরব্বীস্থানীদের পরামর্শে পড়শী একজন ধাত্রীর সাহায্যে সন্তান প্রসব করার চেষ্টা করে। রাতভর নিরারুণ কষ্ট ভোগ করে সে। নিরুপায় হয়ে স্বামী স্থানীয় একটি ক্লিনিকে ভর্তি করলে মৃত পুত্রসন্তান প্রসব হয়। কম বয়সে নিজের পছন্দে বিয়ে,অজ্ঞতা আর সচেতনতার অভাবে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে এসেছে নাবিলা।
নিজের করুণ অভিজ্ঞতার কথা বলতে গিয়ে কান্নায় ভেঙে পড়েন রাজধানীর মাতুয়াইল এলাকার বিবিএ শিক্ষার্থী নাবিলা (ছদ্মনাম)।
অজ্ঞতা ও অসচেতনতার কারণে নাবিলার মতো অকালে সন্তান জন্ম দিতে গিয়ে নানা স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পড়েন অনেকে। মারা যাচ্ছে শিশু এবং স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে প্রসূতি নারী। অন্যদিকে সচেতনতার অভাবে অসময়ে গর্বধারণের কারণে কিশোরী মাতার সংখ্যাও বাড়ছে।
বাংলাদেশে মাতৃমৃত্যুর হার ২০০১ সাল থেকে ২০১৬ সালে ৩২২ থেকে কমে ১৭০ (প্রতি লাখ জীবিত জন্মের মধ্যে) হয়েছে। নবজাতকের মৃত্যুহার,শিশু মৃত্যুহার কমেছে এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের অপুষ্টির হার কমেছে। অন্যদিকে জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, দেশে ১ লাখ শিশু জন্ম নিতে গিয়ে ১৯৬ জন নারীর মৃত্যু হয়েছে।
প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবা দেয়া বা মানুষের দোরগোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পৌঁছে দিতে ২০০৯ সালে আওয়ামী লীগ সরকার উদ্যোগ গ্রহণ করে। কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ কার্যক্রম শুরু হয়। ১৯৯৮ সাল থেকে। তখন প্রতি ৬ হাজার গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য একটি করে কমিউনিটি ক্লিনিক স্থাপনের সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছিল। প্রাথমিকভাবে ১৩,৫০০টি ক্লিনিক স্থাপনের পরিকল্পনা করা হয়। ১৯৯৮-২০০১ সালের মধ্যে ১০,৭২৩টি ক্লিনিক নির্মাণ কাজ শেষ হয় এবং অধিকাংশ জনগণের সুবিধার্থে চালু করা হয়। ২০০১ সালে সরকার পরিবর্তনের পর কমিউনিটি ক্লিনিকের কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়। পরবর্তীতে ২০০৯ সালে কমিউনিটি ক্লিনিক পুনরায় কার্যক্রম শুরু করে । বর্তমানে এ ক্লিনিক থেকে প্রায় ৮২ শতাংশ স্থানীয় জনগণ স্বাস্থ্যসেবা নিয়ে থাকেন।
কমিউনিটি ক্লিনিকে নারীর গর্ভকালীন প্রসবকালীন এবং প্রসবোত্তর জরুরি সেবা প্রদান এবং কোনো জটিলতা দেখা দিলে যতদ্রুত সম্ভব প্রসুতিকে সেবাকেন্দ্রে পাঠিয়ে স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা। জনগণের দোরগোঁড়ায় এসব ক্লিনিক হওয়ায় ৬ সপ্তাহের মধ্যে এবং শিশুদের ভিটামিন ‘এ’ ক্যাপসুল প্রদান করা হয় এখানে। ফলে জরুরি ভিত্তিতেই শুধু নয় আরো নানা কারণে বিভিন্ন ধরণের স্বাস্থ্যসেবা পেয়ে থাকেন গর্ভাবস্থায় নারী।
বর্তমানে নিরাপদ মাতৃত্ব নিশ্চিত করতে সরকার কাজ করে যাচ্ছে। ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের লক্ষ্যে নেয়া বিভিন্ন কার্যক্রমের অংশ হিসেবে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৫ বছর মেয়াদী চতুর্থ স্বাস্থ্য, জনসংখ্যা ও পুষ্টি কর্মসূচি বাস্তবায়ন করছে। জরুরি প্রসূতি সেবা কার্যক্রমসহ মা ও শিশুস্বাস্থ্যের উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের ৬ মাসব্যাপী সিএসবি প্রশিক্ষণ, ভাউচার স্কিম ও ৩ বছর মেয়াদী মিডওয়াইফারি কোর্স চালু করা হয়েছে।
২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণের লক্ষ্যে দেশে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে ৭০ জনে নামিয়ে আনার লক্ষ্যে কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হবে। চলতি বছরে মাতৃমৃত্যুর হার লাখে ১৭২ জন।
১৯৯৭ সাল থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ মে এ দিনটিকে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস হিসেবে ঘোষণা করেন। তিনি বলেন,আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ২০৩০ সালের মধ্যে এসডিজি অর্জনের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লাখে জীবিত জন্মে ৭০ এর নিচে নামিয়ে আনা। এই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে জাতীয় ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও রূপকল্প ২০২১ এর আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় ৪র্থ স্বাস্থখাত কর্মসূচি (২০১৭-২২) বাস্তবায়ন করে যাচ্ছে। এতে মাতৃমৃত্যু ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।
মাতৃস্বাস্থ্য নিশ্চিত করার অংশ হিসেবে বিষয়টিকে গ্ররুত্ব দিয়ে বর্তমান সরকার নারীর প্রসবপূর্ব, প্রসবকালীন, প্রসবপরবর্তী ও নবজাতকের পরিচর্যার উন্নয়নে জরুরি প্রসূতিসেবা কর্মসূচি ও নিরাপদ প্রসব নিশ্চিতে ৩ বছর মেয়াদী ‘মিডওয়াইফারি কোর্স’ চালু করেছ্ েনবজাতকের সুরক্ষায় ‘জাতীয় নবজাতক স্বাস্থ্য কর্মসূচি’ বাস্তবায়িত হচ্ছে।
ন্যাশনাল ইন্সটিটিউট অব পপুলেশন রিসার্চ এন্ড ট্রেনিং (নিপার্ট),আমেরিকান প্রতিষ্ঠান মেজর ইভালুয়েশন এবংয় আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইসিডিডিআরবির যৌথ জরিপে দেখা যায়,বাংলাদেশে গত ১০ বছরে মাতৃমৃত্যুর হার উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাস পেয়েছে।এই হার প্রায় চল্লিশ শতাংশ কমে প্রতি এক লাখে জীবিত জন্মে মাতৃমৃত্যু বর্তমানে ১৯৪ এ এসে দাঁড়িয়েছে বলে এক সরকারি জরিপে উল্লেখ করা হয়। ২০১০ সালে প্রতিলাখে মাতৃমৃত্যুর হার ১৯৪ এ নেমে এসেছে যেটা দশবছর আগে ৩২২ জন এ ছিল।
জরিপে দেখা যায়,সন্তান জন্মদানের হার কমে যাওয়াসহ কয়েকটি কারণে এই সাফল্য অর্জিত হলেও ঐ জরিপে বলা হয়েছে যে, শহর ও গ্রাম এবং অঞ্চলভেদে মাতৃমুৃত্যুর হারের মধ্যে বড় ধরনের পার্থক্য রয়েছে।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/সেলিনা শিউলী/-আসচৌ/আহো/০৯১৫/এসএইচ