বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৪ : শিশুর বিকাশে মায়ের দুধের বিকল্প নেই

113

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৪
শিশু বিকাশ-মায়ের দুধ
শিশুর বিকাশে মায়ের দুধের বিকল্প নেই
॥ মো. হাবিবুর রহমান ॥
ঢাকা, ২২ আগস্ট, ২০১৯ (বাসস): শিশুর পুষ্টি, জীবন ধারণ এবং শারিরীক বৃদ্ধির জন্য উপযুক্ত শিশু খাদ্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। মহান সৃষ্টিকর্তা মানব দেহ থেকে সন্তানের জন্য শুধুমাত্র একটি খাদ্য আহরণের ব্যবস্থা রেখেছেন, আর সেটি হচ্ছে মায়ের বুকের দুধ। শিশুর সুস্বাস্থ্য, পুষ্টি ও বেঁচে থাকার জন্য তিনটি নির্ধারক আছে। এগুলো হলো- নিরাপত্তা, যতœ ও রোগ নিয়ন্ত্রণ। এই তিনটির সমন্বয়ের এক উৎকৃষ্ট উদাহরণই হলো মায়ের বুকের দুধ।
মানব সন্তান পৃথিবীতে আসার সাথে সাথেই আল্লাহ তাআলার রহমতে প্রতিটি মায়ের বুকে তাঁর অনাগত সন্তানের জন্য খাদ্য প্রস্তুত হতে থাকে। জন্মের সাথে সাথে শিশুকে বুকে দিলেই শিশু তার ক্ষুধা, তৃষ্ণা মিটানোর সুধা পেয়ে যায়। প্রথমত তিন/চারদিন শিশু তার মায়ের বুকের দুধ থেকে যে দুধ পায় তা শালদুধ। শালদুধ পরিমাণে কম। কিন্তু জন্মের পরপর শিশুর অপরিপক্ক পাকস্থলির সীমিত ধারন ক্ষমতার জন্য যথেষ্ট। এই শালদুধ যে শুধু শিশুর ক্ষুধা ও তৃষ্ণা মিটায় তা নয়, শিশুকে সুস্থ রাখার জন্য বিভিন্ন উপাদানও সরবরাহ করে। যে কারণে শালদুধকে বলা হয়, জীবনের প্রথম টিকা।
মায়ের দুধ পান করে শুধুমাত্র শিশুরাই উপকৃত হয় না, বরং মায়েরা, তাদের পরিবার এবং সামগ্রিকভাবে সমাজও উপকৃত হয়। মায়ের দুধ শিশুর জীবন ধারনের প্রথম ছয়মাসে শুধুমাত্র প্রয়োজনীয় পুষ্টিই সরবরাহ করে না বরং পাচঁটি বিভিন্ন রোগের প্রতিরোধক হিসেবেও কাজ করে। শৈশবে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ার ফলে পরবর্তী জীবনে সেই শিশু বিভিন্ন রোগ থেকে মুক্ত থাকে।
শিশুর শারীরিক গঠন ও শিশুস্বাস্থ্য সুরক্ষায় মায়ের বুকের দুধ অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। শুধু মায়ের বুকের দুধ পান করলে শিশুরা পায় সঠিক পুষ্টি, পায় সুস্থভাবে বেড়ে ওঠার শক্তি আর মগজের বিকাশের জন্য সব ধরনের পুষ্টি উপকরণ। শিশুরা পায় শ্রেষ্ঠ সুরক্ষা। শ্বাসনালি সংক্রমণ, ডায়রিয়া ও অন্যান্য জীবনঘাতী রোগ থেকে রক্ষা পায়। শিশুরা সুরক্ষা পায় স্থুলত থেকে। অসংক্রামক রোগ যেমন- হাপানি ও ডায়াবেটিস থেকেও তারা পায় সুরক্ষা। মায়ের বুকের দুধ শিশুর জন্য প্রতিষেধক। এছাড়া মাতৃদুগ্ধ শিশুর বুদ্ধিদীপ্ততা ও চোখের তীক্ষèতা বাড়ায়। শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে ঐ মায়ের অল্প সময়ের মধ্যে গর্ভধারণ ঝুঁকি কম থাকে।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার পরামর্শ অনুযায়ী, জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ানো আরম্ভ করতে হবে। কারণ, অনেক গবেষণায় দেখা গেছে- যে শিশুদের ডায়রিয়া, শ্বাসতন্ত্রের প্রদাহ, নিউমোনিয়া, কান পাকা, মেনিনজাইটিস ইত্যাদি রোগ থেকে মায়ের দুধ শিশুকে সুরক্ষা করে।
আমাদের দেশের মায়েরা নবজাতক শিশুকে বুকের দুধ খাওয়ান। কিন্তু বিভিন্ন কারণে এ প্রবণতায় কিছুটা পিছিয়ে পড়েছিল। গত কয়েক বছরে বিভিন্ন মিডিয়ার মাধ্যমে মায়েদের বুকের দুধ খাওয়ানোর উপর ব্যাপক প্রচারণার ফলে মানুষের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত ৫ বছরে ৬ মাস বয়সী শিশুদের শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানোর হার ৪৭ শতাংশ থেকে বেড়ে বর্তমানে ৬৪ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী, জন্ম থেকে ছয় মাস বয়স পর্যন্ত পৃথিবীর সকল শিশুকে শুধুমাত্র মায়ের দুধ খাওয়ানো হলে বছরে ১৫ লাখেরও বেশি শিশুর অকাল মৃত্যু রোধ করা সম্ভব।
প্রতিবছরের মত এ বছরও দেশব্যাপী নানা আয়োজনের মধ্য দিয়ে গত ১ আগস্ট ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ দিবস’ পালিত হয়েছে। একই সঙ্গে ১ থেকে ৭ আগষ্ট ২০১৯ তারিখ পর্যন্ত পালিত হয়েছে ‘বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ’। মাতৃদুগ্ধ দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য বিষয় ছিল ‘মায়ের দুধ পান সুস্থ জীবনের বুনিয়াদ’। বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ উপলক্ষে দেশব্যাপি নানা কর্মসূচির আয়োজন করা হয়েছে। এর মধ্যে সরকারি ও বেসরকারি স্কুলে প্রতিপাদ্য বিষয়ের ওপর রচনা প্রতিযোগিতা, চিত্রাঙ্কন প্রতিযোগিতা ও পুষ্টিমেলা উল্লেখযোগ্য। এ ছাড়াও গত ১ থেকে ৭ আগস্ট মোবাইল ফোনে বিশ্ব মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের বার্তা প্রচারিত হয়েছে এবং বিভিন্ন স্থানে মাতৃদুগ্ধ ব্যবস্থাপনা ক্যাম্প স্থাপন করা হয়। মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহের প্রতিপাদ্য বিষয় নিয়ে সভা, সেমিনার ও আলোচনা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। মাতৃদুগ্ধ সপ্তাহ উপলক্ষে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী বলেন, শুধু মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানোর ফলে প্রতি বছর ৮ লাখ ২৩ হাজার শিশু ও ২০ হাজার মা মৃত্যুর হাত থেকে রক্ষা পেয়ে থাকেন।
পুষ্টি বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, সরকারকে মায়ের দুধ ও সম্পুরক খাদ্যের বিষয়ে জোর প্রচারণায় নামতে হবে। শিশু বিশেষজ্ঞদের মতে মায়ের দুধে ২০০টি পুষ্টি উপাদান রয়েছে। পৃথিবীর আর কোন একক খাদ্যে এতো পুষ্টি নেই। পুষ্টি বিজ্ঞানীরা আরো বলেন, জন্মের এক ঘন্টার মধ্যে শিশুকে মায়ের দুধ দেয়া শুরু করলে অন্ততঃ ৩৭ হাজার নবজাতকের প্রাণ রক্ষা করা সম্ভব। অন্যদিকে গুড়ো দুধ বা অন্যান্য প্রক্রিয়াজাত শিশুখাদ্য শিশু মৃত্যুর হার ২৫ শতাংশ বাড়িয়ে দেয়।
শিশুর জন্য খাদ্য হিসেবে মায়ের দুধ সোনার মানদন্ড স্বরূপ। সকল গর্ভবতী মাকে শিশু ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর বুকের দুধ দেওয়ার আগ্রহ বাড়াতে হবে। মা ও শিশুর অপুষ্টি, সুস্থ জাতি গঠনের অন্যতম প্রধান অন্তরায়। তাই, প্রসব পরবর্তী মায়ের জন্য পুষ্টিকর খাদ্য সুনিশ্চিত করতে হবে, যেন তার শিশু পর্যাপ্ত পরিমাণে বুকের দুধ পায়। আমাদের সকলের উচিৎ সব মাকে এই মর্মে সচেতন করা যে, একজন মা একটু ধৈর্য সহকারে চেষ্টা করলেই তার সন্তানকে সফলভাবে বুকের দুধ পান করাতে সক্ষম। পবিত্র কোরআনে নবজাতককে মাতৃদুগ্ধ পান করানোর সময়সীমা সম্পর্কে সুনির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে- ‘যে স্তন্যপানকাল পূর্ণ করতে চায়, তাঁর জন্য জননীরা তাঁদের সন্তানদের পূর্ণ দুই বছর দুগ্ধপান করাবেন। জনকের কর্তব্য যথাবিধি তাঁদের ভরণপোষন করা’ (সুরা আল বাকারা, আয়াত-২৩৩)।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মোহার/আরজি/১৭২০/আহো/-এসএইচ