বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : পাঠ্যপুস্তকে লূৎফা সানজিদার সাফল্যের গল্প

291

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
পাঠ্যপুস্তকে লূৎফা সানজিদার সাফল্যের গল্প
ঢাকা, ২২ আগস্ট, ২০১৯ (বাসস) : লুৎফা সানজিদা ছিলেন আরও পাঁচজন গৃহবধূর মতোই। তবে স্বপ্ন ছিলো সংসারে স্বচ্ছলতা আনতে নিজে কিছু করার। তাই হাতে তুলে নেন সুই-সুতা। শুরু করেন সেলাইয়ের কাজ। শিশুদের পোশাক ও পাঞ্জাবি তৈরি করে সরবরাহ করতে থাকেন স্থানীয় বাজারে। মাত্র ১৫ হাজার টাকা পুঁজি নিয়ে ব্যবসা শুরু করে সেইদিনের সাধারণ গৃহবধূ লুৎফা সানজিদা এখন কোটিপতি। তার সাফল্যের গল্প এখন নবম-দশম শ্রেণির পাঠ্যপুস্তকে।
আসলে শুনতে গল্প হলেও ঘটনাটি সত্যি। বলছি বন্দরনগরী চট্টগ্রামের মেয়ে লূৎফা সানজিদার কথা।
তিনি বলেন, রক্ষণশীল পরিবারে জন্ম, তবুও থেমে থাকেনি। ছোটবেলা থেকেই ইচ্ছে ছিল পড়ালেখা করে বড় কিছু হবো। কিন্তু বিয়ে হয়ে যাওয়ায় তা আর হয়ে ওঠেনি। এরপর সিদ্ধান্ত নিই কিছু করবো। সেখান থেকেই শুরু।
শুরুর দিনগুলোর কথা শোনা যাক তার মুখে, তখন পুঁজি মাত্র ১৫ হাজার টাকা। কিন্তু আমার ব্যবসার আগ্রহ দেখে ১৯৮৯ সালে এগিয়ে আসেন এক কাজিন।
‘তার কাছ থেকে ৩০ হাজার টাকা ধার নিয়ে নগরীর চকভিউ মার্কেটে শোরুম দিই একটি। সেখানে নিজের সেলাই করা কাপড় বিক্রি করি। এরপরই মূলত ধীরে ধীরে ধরা দিতে থাকে সাফল্য। ’
একটি শোরুম থেকে তিনি এখন অনিন্দ্য বুটিক হাউস ও অনিন্দ্য বিউটি পার্লারের স্বত্বাধিকারী। নগরীর বড়পুল মোড়ের হালিশহর এল ব্লক ও হালিশহর নিউ আই ব্লকে পৃথকভাবে অনিন্দ্য বুটিক হাউস ও অনিন্দ্য বিউটি পার্লার চালাচ্ছেন লূৎফা সানজিদা।
জানালেন, এখন চট্টগ্রামের আফমী প্লাজায়ও তার অনিন্দ্য বুটিক হাউসের একটি শোরুম রয়েছে। প্রায় ৩০ বছরের ব্যবধানে সংগ্রামী এ নারী এখন সফল উদ্যোক্তা।
জাতীয় শিক্ষাক্রম ও পাঠ্যপুস্তক বোর্ড থেকে প্রকাশিত নবম-দশম শ্রেণির ব্যবসায় উদ্যোগ বইয়ে স্থান পেয়েছে লূৎফে সানজিদার সংগ্রামের গল্প।
সারাদেশের বাণিজ্য বিভাগের শিক্ষার্থীরা পড়ছেন কঠোর পরিশ্রম করে সফল হওয়া এক নারীর গল্প। শিক্ষার্থীদের অনুপ্রাণিত করতেই লুৎফা সানজিদার বর্ণাঢ্য জীবনী তুলে ধরা হয়েছে বইটির দ্বাদশ অধ্যায়ে।
সফল নারী উদ্যোক্তা লুৎফা সানজিদা বলেন, ‘বাণিজ্য বিভাগের নবম ও দশম শ্রেণির লাখ লাখ শিক্ষার্থী আমার সাফল্যের গল্প পড়বে, দেশের মানুষ জানবেন- এটা কখনও কল্পনাও করিনি। পাঠ্যবইয়ে আমার সংগ্রামের ইতিহাস তুলে ধরায় এটিকে জীবনে অনেক বড় পাওয়া মনে করছি। কারণ শিক্ষার্থীরা পড়াশোনা শেষে ব্যবসা শুরু করলে তাতে সফল হতে এ সংগ্রামের কাহিনী তাদের মানসিক শক্তি ও সাহস জোগাবে। কিশোর শিক্ষার্থীরাও অনুপ্রাণিত হবে। আজ নিজেকে কিছুটা সফল মনে হচ্ছে।’
সাফল্যের সঙ্গে ব্যবসা পরিচালনার পাশাপাশি পরিবারকেও আগলে রেখেছেন শক্তভাবে। তার দুই ছেলে তানজিল ও তাহমিম রহমানকে উচ্চশিক্ষায় শিক্ষিত করে তুলছেন। বড় ছেলে তানজিল একটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে উচ্চশিক্ষা শেষ করে এখন ঢাকায় ব্যবসা করছেন। ছোট ছেলে তাহমিম সিলেটে শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ে পড়াশোনা শেষ করেছেন।
সফল উদ্যোক্তা সানজিদার প্রতিষ্ঠিত দুটি বুটিক হাউস ও দুটি পার্লারে প্রায় ৩০জনের মতো নারী-পুরুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। তবে বেশির ভাগই নারী কর্মী। যারা খুবই অসহায় ছিলো। এখন নিজেরা চাকরি করে পরিবারে অবদান রাখছে।
‘এটা আমার কাছে বেশ গৌরবের মনে হয়। কারণ আমি অনেক অসহায় তরুণীর পাশে দাঁড়াতে পারছি,’ যোগ করেন সানজিদা।
এদিকে শুধু ব্যবসা নয়, সামাজিক দায়বদ্ধতার অংশ হিসেবে প্রতিবন্ধী নারী, স্বামী পরিত্যক্তা ও নির্যাতিত নারীদের বিনামূল্যে বুটিক ও পার্লারের প্রশিক্ষণও দিয়েছেন তিনি। তার ভাষ্য, এখান থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে যদি মেয়েরা আত্ম-কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে পারে সেটাও আমার সাফল্য।
বইয়ে যা পড়ছে শিক্ষার্থীরা:
নবম-দমশ শ্রেণির বাণিজ্য শাখার ওই বইটির দ্বাদশ অধ্যায়ে ‘সফল উদ্যোক্তাদের জীবনী থেকে শিক্ষণীয়’ শিরোনামে পড়ানো হচ্ছে সফল উদ্যোক্তাদের সফলতার গল্প। বইটির ১৩৬ ও ১৩৭ পৃষ্ঠায় তুলে ধরা হয়েছে লুৎফা সানজিদার সফল হওয়ার গল্প।
দুই পৃষ্ঠায় লুৎফা সানজিদা সম্পর্কে বলা হয়েছে, বন্দরনগরী চট্টগ্রামের হালিশহরের অনিন্দ্য বুটিক ও অনিন্দ্য বিউটি পার্লারের মালিক লুৎফা সানজিদা ১৫ হাজার টাকা দিয়ে ব্যবসা শুরু করে আজ কোটিপতির তালিকায় নাম লিখিয়েছেন। তিলে তিলে গড়ে তুলেছেন বুটিক ও পার্লার হাউস। সংগ্রামই তার জীবনের মূলমন্ত্র। অবিরাম চেষ্টা না থাকলে তার আজকের অবস্থায় আসা কোনোভাবেই সম্ভব হতো না। যখনই কোনো সমস্যা দেখা দিয়েছে তখনই ধৈর্য ও পরিশ্রম দিয়ে তা অতিক্রম করেছেন।
যখন তার এসএসসি পরীক্ষা দেওয়ার সময়, তখন বিয়ে হয়। সংসারের প্রয়োজনে তাকে করতে হয় পার্টটাইম চাকরিও। পরে ১৯৮৯ সালে চকভিউ মার্কেটে একটি শোরুম খোলেন। এখানে বিকিকিনি ভালো হওয়ায় ১৯৯৫ সালে মাইডাস চট্টগ্রাম থেকে ৫০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে চিটাগাং শপিং কমপ্লেক্সে আরেকটি শোরুম খোলেন।
ব্যবসা জমে ওঠে। পরিবারে স্বচ্ছলতা আসতে থাকে। ২০০৪ সালে একটি বিউটি পার্লার দেন। ব্যবসা করে তিনি এখন সফল।
দ্বাদশ অধ্যায়ের ভূমিকায় বলা হয়েছে, দেশ স্বাধীনের পর বিগত ৪০ বছরে বেশ কয়েকজন উদ্যোক্তা ছোট ব্যবসা দিয়ে শুরু করে দেশের শ্রেষ্ঠ উদ্যোক্তা হিসেবে পরিচিত হয়ে ওঠেন। তাদের প্রতিষ্ঠিত ব্যবসায় দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে গুরুত্ব¡পূর্ণ অবদান রেখে চলেছে। তাদের মধ্যে অন্যতম চট্টগ্রামের লুৎফা সানজিদা।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/মাআ/আসচৌ/০৯৪৫/আহো/-এসএইচ