বদলে গেছে পঞ্চগড়ের বিলুপ্ত ৩৬ ছিটমহলের দৃশ্যপট

241

পঞ্চগড়, ৩১ জুলাই ২০১৯ (বাসস): ছিটমহল বিনিময়ের মাত্র চারবছরের মধ্যে সম্পূর্ণ বদলে গেছে পঞ্চগড়ের ৩৬ বিলুপ্ত ছিটমহলের দৃশ্যপট। ব্যাপক উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হওয়ায় চারবছরে সেখানকার বাসিন্দাদের জীবনযাত্রাও পাল্টে গেছে।
সরকারের অগ্রাধিকারভিত্তিক কার্যক্রমে বিলুপ্ত ছিটবাসির ৬৮ বছরের বঞ্চনা যেন ঘুচে গেছে। নানান সুযোগ সুবিধা পেয়ে তারা খুব খুশি। শিক্ষা, চিকিৎসা, রাস্তা-ঘাট, বিদ্যুৎসহ সরকারের সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির সকল সুবিধা এখন তাদের হাতের নাগালে।
বাংলাদেশের পঞ্চগড়, কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট ও নীলফামারী জেলায় ভারতের ১১১টি ছিটমহল ছিল। আর ভারতের অভ্যন্তরেও বাংলাদেশের ৫১টি ছিটমহল ছিল। ১৯৭৪ সালের স্থলসীমান্ত চুক্তি আলোকে এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ২০১৫ সালের ৩১ জুলাই মধ্যরাতের পর বাংলাদেশ ও ভারতের অভ্যন্তরে থাকা ছিটমহলগুলো উভয়দেশের সাথে একীভূত হয়।
এদিকে, ছিটমহল বিনিময়ের চারবছর পূর্তিতে বিভিন্ন কর্মসূচী নিয়েছে পালন করেছে বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোর বাসিন্দারা। এর মধ্যে ছিল- আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, রাত ১২টা ১ মিনিটে ৬৮টি মোমবাতি প্রজ্বলন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের প্রতিকৃতিতে পুষ্পমাল্য অর্পণ, প্রতিটি বাড়িতে আলোকসজ্জা , খেলাধুলা, মসজিদে মিলাত মাহফিল ও মন্দিরে বিশেষ প্রার্থনা।
জেলা প্রশাসন সূত্রে জানা যায়, বিলুপ্ত ছিটমহল এলাকা বাংলাদেশ ভুখন্ডের সাথে একীভ’ত হওয়ার পর এ সকল এলাকার উন্নয়ন ও নাগরিকদের অধিক সুবিধা দিতে সরকার ব্যাপক উন্নয়নমুলক কার্যক্রম শুরু করেছে। বিলুপ্ত ছিটমহল এলাকার ঘরে ঘরে পৌছে দেয়া হয়েছে বিদ্যুৎ। রাস্তা ঘাট ব্রিজ-কালভার্ট, স্কুল-কলেজ, মসজিদ-মন্দির, গুচ্ছগ্রাম, কমিউনিটি ক্লিনিক, খাল খনন, বাজার শেড, বিশুদ্ধ খাবার পানি ও পয়ঃনিস্কাশন ব্যবস্থা উন্নয়নের কাজ প্রায় শেষের দিকে।
এছাড়াও বিলুপ্ত ছিটমহলের নাগরিকদের বয়স্ক ভাতা, বিধবা ভাতা, ভিজিডি-ভিজিএফ সহ সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনীর সকল সুবিধা নিশ্চিত করা হয়েছে।
পঞ্চগড়-নীলফামারী জেলার ছিটমহল সমন্বয় কমিটির সাবেক সভাপতি ও বিলুপ্ত গাড়াতী ছিটমহলের সাবেক সভাপতি মফিজার রহমান জানান, পঞ্চগড় সদর ৭৮ নং গারাতী ছিটমহলে ৩ কোটি ৫০ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৫ বিঘা জমির উপর আইসিটি ভবন নির্মান কাজ শেষের পথে, ১টি কলেজ নির্মান করা হয়েছে। ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১টি হাইস্কুল, ৭৫ লাখ টাকা ব্যয়ে বঙ্গবন্ধু আলিম মাদ্রাসা, ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১টি প্রাথমকি বিদ্যালয় ও ১টি প্রতিবন্ধী স্কুল, ৬৬ লাখ টাকা ব্যয়ে ১টি কমিউনিটি সেন্টার, ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১টি কমিউনিটি ক্লিনিক, ২২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১ টি ডাকঘর, ৯০ লাখ টাকা ব্যয়ে ৬ টি ব্রীজ , ৪৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ১টি বাজার নির্মাণ, ৩ লাখ টাকা ব্যয়ে একটি পুলিশ ফাঁড়ি নির্মান এবং ১৯ কিলোমিটারের মধ্যে ৯শ’ বাড়িতে বিদ্যুৎ সংযোগ প্রদান করা হয়েছে। ৫ হাজার ৩০০ বিঘা জমির খতিয়ান পেয়েছেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন।
পঞ্চগড়ে স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মনিরুজ্জামান জানান, পঞ্চগড় সদর, দেবীগঞ্জ ও বোদা উপজেলার ৩৬ টি বিলুপ্ত ছিটমহলে প্রায় ৯০ কোটি টাকার উন্নয়ন কর্মকান্ড চলছে। এর মধ্যে বোদা উপজেলায় ৫০ কিলোমিটার ও দেবীগঞ্জের দহলাখাগড়াবাড়ী ছিটমহলে ৫০ কিলোমিটার রাস্তা পাকাকরনের কাজ শেষ করা হয়েছে। একটি কমিউনিটি ক্লিনিক, ৪টি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ৫ কিলোমিটার খাল খনন কর্মসূচী, ৪টি হাট শেড, ৭টি মসজিদ ও ৫টি মন্দিরের নির্মান কাজ চলছে।
জেলা পরিষদ সূত্রে জানা যায়, বিলুপ্ত ছিটমহল গুলোতে জেলা পরিষদ ১৬২ কোটি টাকা ব্যয়ে ২৫টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে।
সমাজসেবা অধিদপ্তরের জেলা কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, বিলুপ্ত ছিটমহলগুলোতে ১ হাজার ১৬৫ জনকে বয়স্ক ভাতা, ৪৯১ জনকে বিধবা ভাতা এবং ৩২৪ জনকে প্রতিবন্ধি ভাতা প্রদান করা হচ্ছে। এছাড়াও, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের মাধ্যমে ৩৮০ জন নারীকে মাতৃত্বকালিন ভাতা এবং ৩ হাজার ২৫০ জনকে ভিজিডি কার্ড প্রদান করা হয়েছে।
দেবীগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) প্রত্যয় হাসান জানান, সরকার ছিন্নমূল জনগোষ্ঠির বাসস্থানের জন্য দেবীগঞ্জ উপজেলার বিলুপ্ত কোটভাজনী ছিটমহলের বালাসুতি এলাকায় ‘সিডিআরপি’ প্রকল্পের আওতায় প্রায় ৫৫ লাখ টাকা ব্যয়ে ৩০টি পরিবারের জন্য স্যানিটেশন ব্যবস্থাসহ একটি গুচ্ছগ্রাম নির্মাণ করেছে।
তিনি জানান, দেবীগঞ্জে উপজেলার বিলুপ্ত দহলা খাগড়াবাড়ী,বালাপাড়া,কোটভাজনীসহ ৩৬টি ছিটমহলে ২৭ কোটি ১২ লাখ টাকা ব্যয়ে ২২৬ কিলোমিটার এলাকায় ৯ হাজার গ্রাহককে বিদ্যুৎসংযোগ প্রদান করা হয়েছে। সংযোগের ফলে এ অঞ্চলের ছাত্র-ছাত্রীরা স্বাস্থ্য সেবা, কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন ধারনা, ইন্টারনেটের মাধ্যমে চাকুরির আবেদন করছেন।
পঞ্চগড়ের জেলা প্রশাসক সাবিনা ইয়াসমিন বলেন, ‘জেলার বিলুপ্ত ছিটমহলগুলো বাংলাদেশের ভৌগলিক সীমারোখার অর্ন্তভুক্ত হওয়ার পরপরই সরকার বিভিন্ন উন্নয়ন পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে।সেখানাকার বাসিন্দাদেরকে নাগরিকত্ব প্রদান ও ভোটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। ছিটমহলের জন্য বিশেষ বরাদ্দ এবং বিভিন্ন কাজে তাদেরকে অগ্রাধিকার দেয়া হচ্ছে। ফলে সেখানকার উন্নয়নের চিত্রটা এখন বাহ্যিকভাবেই দেখা যাচ্ছে।’