বাংলাদেশে বৈদেশিক বিনিয়োগের পরিবেশ অত্যন্ত অনুকূল

547

ঢাকা, ১৩ জুলাই, ২০১৯ (বাসস): বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনীতি সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের ফলে আরো জোরদার হচ্ছে। দেশটির অভ্যন্তরীণ বাজারের ব্যাপক চাহিদার বিষয়টি বহুজাতিক কোম্পানিগুলো বিবেচনায় রেখেছে।
গতকাল নিক্কেই এশিয়ান রিভিওয়ের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, ১৬ কোটি ৮০ লাখ জনসংখ্যা অধ্যুষিত দক্ষিণ এশিয়ার একটি অত্যন্ত কৌশলগত স্থানে অবস্থিত বাংলাদেশের জনসংখ্যার এক তৃতীয়াংশের বয়স ২৫ বছরের কম। বিদেশী বিনিয়োগকারীরা বাংলাদেশকে একটি শক্তিশালী ক্রমবর্ধমান বাজার হিসেবে দেখছে।
ইউনাইটেড নেশনস কনফারেন্স অন ট্রেড অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (ইউএনসিটিএডি) জানিয়েছে, গত বছর বাংলাদেশে সরাসরি বৈদেশিক বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ ৬৮ শতাংশ বেড়ে রেকর্ড ৩ দশমিক ৬১ বিলিয়নে দাঁড়িয়েছে। ২০১১ সালের চেয়ে এটা তিনগুণ বেশি।
জাপান টোবাকো বাংলাদেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম সিগারেট নির্মাতা আকিজ গ্রুপের কোম্পানি ঢাকা টোবাকোকে ১ দশমিক ৫ বিলিয়ান মার্কিন ডলারের বিনিময় ক্রয় করেছে। এর ফলে দেশে বিদেশি বিনিয়োগের পরিমাণ অনেক বেড়ে গেছে।
অন্যান্য প্রধান বিনিয়োগের মধ্যে চীনের সাংহাই ও শেনজেন স্টক এক্সচেঞ্চ ঢাকা স্টক এক্সচেঞ্জের ২৫ শতাংশ স্টেক কিনেছে। এটি বেইজিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের একটি অংশ। এছাড়া চীনের আলিবাবা গ্রুপ হোল্ডিং এর কোম্পানি আলিপে মোবাইল আর্থিক সেবাদানকারী কোম্পানি বিকাশের ২০ শতাংশ শেয়ার কিনেছে।
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের বাংলাদেশের প্রতিনিধি র‌্যাগনার গুডমুন্ডসন নিক্কেই এশিয়ান রিভিউকে বলেন, ‘এটা ব্যবসা ও বিনিয়োগ পরিবেশ বাড়াতে চলমান সংস্কারের গুরুত্বের পাশাপাশি দেশের অবকাঠামোগত উন্নয়নের গুরুত্বকে তুলে ধরেছে।’
তিনি আশা করেন যে, ২০১৯ সালের জুন মাসের শেষ নাগাদ চলতি অর্থবছরের এফডিআই গত বছরের তুলনায় ২৫ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে।
বাংলাদেশ সরকার বর্তমানে মেট্রোরেল, সেতু, টানেল, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, বিদ্যুৎ কেন্দ্র ও অন্যান্য প্রকল্প নির্মাণ করছে। এতে শত শত কোটি মার্কিন ডলারের বিদেশী বিনিয়োগ রয়েছে। এর অধিকাংশই এসেছে চীন ও জাপান থেকে।
দেশজুড়ে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল স্থাপন ও বিনিয়োগবান্ধব পরিবেশ তৈরি বৈদেশিক বিনিয়োগ আকর্ষণের অন্যতম প্রধান কৌশল।
এর কারণে বাংলাদেশ ইতোমধ্যেই জাপানের সুমিতোতো, সোজিৎজ, নিপ্পন স্টিল, শিনওয়া ও মারুহিসার মতো কোম্পানিগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছে।
বাংলাদেশে ইকোনোমিক জোনস অথোরিটি (বেজা) জানিয়েছে, সোজিৎজ একাই বন্দর নগরী চট্টগ্রামের মীরসরাইয়ে একটি বেসরকারি বন্দর ও শিল্প পার্ক নির্মাণে ২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার বিনিয়োগ করবে।
ইতোমধ্যে অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোতে ১৭.৯ বিলিয়ান বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব অনুমোদন করা হয়েছে।
বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা)’র নির্বাহী চেয়ারম্যান কাজী মো. আমিনুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলাদেশ সুযোগ সুবিধার দেশ। আপনি এর মূল্যায়ন করতে পারেন।’
বিডা প্রধানমন্ত্রীর অফিসের একটি শাখা। এটি বিদেশী বিনিয়োগের ব্যাপারে প্রচারণা চালায়।
ইউএনসিটিএডি জানায়, দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে এফডিআই এর ক্ষেত্রে ভারতের পরেই বাংলাদেশের অবস্থান।
তৈরি পোশাক শিল্পে বাংলাদেশের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী ভিয়েতনামের চেয়ে এফডিআই এ পিছিয়ে আছে। দেশটির এফডিআই’র পরিমাণ ১৫.৫ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। তবে বাংলাদেশ মিয়ানমার, ইথিওপিয়া ও কম্বোডিয়ার চেয়ে এগিয়ে আছে। মিয়ানমার, ইথিওপিয়া ও কম্বোডিয়ার এফডিআই’র যথাক্রমে ৩.৫৮ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, ৩.৩০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ও ৩.১০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার।
ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্ব ব্যাংকের সাবেক শীর্ষ অর্থনীতিবিত ড. জাহিদ হোসেন বলেন, জনসংখ্যা এবং ভৌগলিক দিক থেকে অনুকূল অবস্থান দেশটিকে ভারত, চীন ও জাপানের বড় বাজারের কাছাকাছি নিয়ে গেছে, এই দু’টোই বাংলাদেশের অর্থনীতির মৌলিক শক্তি।
জাহিদ হোসেন বলেন, প্রাতিষ্ঠানিক এবং অবকাঠামোগত দিক থেকে বাংলাদেশের অবস্থান দুর্বল হলেও ওয়াল্ড ইকোনমিক ফোরামের বৈশ্বিক প্রতিযোগিতামূলক সূচকে সামষ্টিক অর্থনীতি নীতির কারণে বাংলাদেশ অনেকটাই ভাল অবস্থানে রয়েছে। তিনি বলেন, মূদ্রা বিনিময় হার ঘ ঘন রদবদল হলেও বাংলাদেশ সামষ্টিক অর্থনীতি ব্যবস্থাপনায় স্থিতিশিলতা বজায় রাখতে সক্ষম হয়েছে।
তিনি বলেন, বাংলাদেশের অর্থনীতি চলতি অর্থবছরের ৩০ জুন নাগাদ ৮ দশমিক ১৩ শতাংশ সম্প্রসারিত বলে ধারনা করা হচ্ছে। বাংলাদেশের ৩ শতাধিক বিলিয়ন মার্কিন ডলারের অর্থনীতির প্রায় ৭৫ শতাংশই বেসরকারি খাতের। অর্থনীতির অন্যান্য সূচকের চিত্রও প্রায় একই ধরনের।
সরকারি পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গত ৩০ জুন সমাপ্ত অর্থবছরে রফতানি ১১ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়ে ৪০ দশমিক ৫৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে উন্নীত হয়েছে। এরমধ্যে ৮০ শতাংশই এসেছে বস্ত্র ও তৈরি পোশাক শিল্প থেকে।
বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, বিগত অর্থ বছরে ১২ বিলিয়নেরও অধিক প্রবাসী বাংলাদেশী দেশে ১৬ দশমিক ৪২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার পাঠিয়েছে। প্রবাসীদের পাঠানো এই অর্থ অতীতের যে কোন সময়ের চেয়ে সর্বোচ্চ। উপসাগরীয় দেশসমূহে বাংলাদেশী শ্রমিকের চাহিদা বৃদ্ধি এবং অবৈধ পথে দেশে অর্থ পাঠানো বন্ধে কার্যকর ব্যবস্থা নেয়ায় এই সফলতা এসেছে।
অর্থ মন্ত্রনালয়ের কর্মকর্তারা জানায়, আগামী ৩০ জুন সমাপ্ত চলতি অর্থ বছরে প্রবাসী বাংলাদেশীদের পাঠানো রেমিটেন্স ২ শতাংশ বৃদ্ধি পাবে বলে আশা করা হচ্ছে। যা, ৩৬২ মিলিয়ন ডলারের বাজেট বাস্তবায়নে সহায়ক হবে। এ সময়ে শুধু ব্যাংকিং চ্যানেলের মাধ্যমে দেশে প্রবাসীদের অর্থ পাঠানো বৃদ্ধি পাবে না, অবৈধ পথে দেশে অর্থ পাঠানোর প্রবনতায়ও প্রবাসীরা নিরুৎসাহিত হবেন।
গত জুন মাসে বাংলাদেশের বৈদেশিক মূদ্রার রিজার্ভ ছিল ৩১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন ডলার। পাচঁ মাসের অধিক সময় আমদানি ব্যয় মেটানোর জন্য এই অর্থ যথেষ্ট।
অবকাঠামো, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, এবং সামাজিক নিরাপত্তা বেস্টনীর মতো কিছু গুরুত্বপূর্ণ খাতে বিনিয়োগ নিশ্চিত করাসহ অন্যান্য খাতে সরকারকে চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হচ্ছে। ব্যাংক সেক্টরে কিছু সমস্যা রয়েই গেছে। গত মার্চ মাসের পরিসংখ্যান অনুযায়ি খেলাপি ঋণের পরিমান ছিল ১২ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। দেশের ৬২ বিলিয়ন জাতীয় বাজেটের প্রায় ২০ শতাংশ। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে দারিদ্র্য উল্লেখযোগ্য হারে হ্রাস পেয়েছে।
ড. জাহিদ হোসেন বলেন, তৈরি পোশাক শিল্প খাত, কৃষি এবং রেমিটেন্স অর্থনীতির মূল চালিকা শক্তি। নতুন অথনীতির পিলার সৃষ্টির ক্ষেত্রে দৃশ্যমান কোন অগ্রগতি নেই। বিনিয়োগ ও উৎপাদনে অগ্রগতি না হলে এই প্রবৃদ্ধি টেকসই হবে না। তিনি বলেন, বাংলাদেশ যদি দেশটির অলস শ্রম শক্তিকে মানব সম্পদে রূপান্তরিত করতে পারে, তাহলে দেশেটির আরো দ্রুত উন্নতি হবে।