মুক্তিযুদ্ধে আত্মদানকারী দুই শহীদের স্বীকৃতি

320

গোপালগঞ্জ, ৬ জুলাই, ২০১৯ (বাসস) : পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর সদস্যরা ১৯৭১ সালের ৯ মে তাদের এদেশীয় দোসরদের সহযোগিতায় দেশের দক্ষিণ পশ্চিমাঞ্চলীয় ছোট শহর গোপালগঞ্জের উপকন্ঠে পাইকারডাঙ্গা ইউনিয়নের স্থানীয় সরকারের একটি কার্যালয়ে অভিযান চালায়।
তাদের লক্ষ্য ছিল স্থানীয় ভূমি অফিসের দু’জন কর্মকর্তা, তহসিলদার আবু মোতালেব মিয়া ও সহকারী তহসিলদার মীর আবুল কাশেম।
আনুমানিক সকাল নয়টায় তাদের অফিস থেকে টেনে হিঁচড়ে বের করে আনা হয়, চালানো হয় নির্মম নির্যাতন এবং নৃশংস নির্যাতনের পর তাদের দু’জনকে সেখানেই গুলি করে হত্যা করা হয়।
১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের কালো রাত্রি থেকে শুরু হওয়া পাকিস্তানী বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞের পর থেকে তারা দু’জন বাংলাদেশের স্বাধীনতার পক্ষে আশেপাশের লোকজনকে সংগঠিত করতে প্রাণপণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছিলেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদেও গোপনে সহায়তা করে যাচ্ছিলেন বলেই তাদেরকে এই নির্মম পরিণতি বরণ করতে হয় ।
মহান স্বাধীনতা যুদ্ধের দীর্ঘ ৪৮ বছর পর তাদের কবর চিহ্নিত করে আত্মত্যাগের স্বীকৃতি হিসেবে কবরে ফলক স্থাপনের মাধ্যমে তাদের প্রতি আনুষ্ঠানিক সম্মাননা জানানো হয়েছে।
‘আমাদের দু’জন সহকর্মী ৪৮ বছর আগে দেশের জন্য সরকারি চাকরিজীবী হিসেবে শহীদ হয়েছেন। তাঁদের এই মহান আত্মত্যাগকে সম্মানিত করতে তাঁদের কবর সংরক্ষণের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে,’ গোপালগঞ্জ জেলা প্রশাসক মোখলেসুর রহমান সরকার জানান ।
এর আগে তিনি অন্যান্য কর্মকর্তা স্থানীয় ও পার্শ্ববর্তী এলাকার জনগনকে নিয়ে তাঁদের আত্মার মাগফেরাতের জন্য দোয়া করেন।
জেলা প্রশাসক বাসস’কে আরো জানান, তিনি রাজস্ব বিভাগের একটি সম্মেলনে দেশের জন্য আত্মদানকারী মোতালেব মিয়া ও আবুল কাশেমের ব্যাপারে জানতে পারেন এবং জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এই দু’জন শহীদের কবর সংরক্ষণের উদ্যোগ নেন।
আবু মোতালেব মিয়া ছিলেন তদানিন্তন গোপালগঞ্জ মহকুমার মকসুদপুর থানার লোহাইর গ্রামের নইমুদ্দিন মিয়ার ছেলে এবং আবুল কাশেম ছিলের তদানিন্তন ঢাকা জেলার (বর্তমান মুন্সিগঞ্জ জেলার) লৌহজং উপজেলার কুমারভোগ গ্রামের আলহাজ্ব মীর তফিজ উদ্দিনের ছেলে।
স্থানীয় প্রবীণদের থেকে জানা যায় যে, মোতালেব মিয়া তার গর্ভবতী স্ত্রী ও দু’বছরের এক ছেলে নিয়ে তহসিল অফিস ভবনেই থাকতেন। অপরদিকে মীর আবুল কাশেম তার স্ত্রী ও ৮ ছেলে-মেয়ে নিয়ে গ্রামে একটি ভাড়া বাড়িতে থাকতেন।
পাইকেরডাঙ্গার অধিবাসী মুক্তিযোদ্ধা আইয়ুব আলী খানের বাড়ি ছিলো তহসিল অফিসের পাশেই। তিনি বলেন, ‘মোতালেব মিয়া ও আবুল কাশেম স্থানীয় তরুণদের স্বাধীনতা যুদ্ধে যাবার জন্য সংগঠিত করতেন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের বিভিন্নভাবে সহায়তা করতেন। দ্রুতই স্বাধীনতা বিরোধী কিছু স্থানীয়দের মারফত খবরটি শুকতাইল কুঠিবাড়ির ওদুদ শিকদার ও রতন রাজাকারের কাছে পৌঁছে যায়।’
আইয়ুব স্মৃতিচারণ করে বলেন, পাকসেনারা এ খবর পেয়ে খুলনা হতে মধুমতি নদী দিয়ে পাইকেরডাঙ্গা গ্রামে প্রবেশ করে। তহসিল অফিসে যাওয়ার পথে অতুল প্রামাণিক ও গ্রাম প্রধান সীতানাথ সরকারের ৬০ বছর বয়সী বিধাব বোনসহ অনেক নিরীহ লোকদের হত্যা করে তারা।
এমনকি ফেরার পথেও পাকিস্তানী বাহিনী তাদের স্বয়ংক্রিয় রাইফেল দিয়ে এলোপাথাড়ি গুলি ছুঁড়ে অনেক লোককে হত্যা ও আহত করে। তারা হিন্দুদের বাড়িঘরে আগুন ধরিয়ে দেয়, তফসিল অফিসের হিন্দু মন্দির ধ্বংস করে দেয়।
মোতালেব ও কাশেমকে হত্যা করে তাঁদের বাড়িঘর লুট করে জ্বালিয়ে দেয় পাকবাহিনী।
স্বামীর নির্মম হত্যাকান্ডের পর মোতালেব মিয়ার স্ত্রী মমতাজ বেগম পাইকেরডাঙ্গা ত্যাগ কওে ছেলে সাজ্জাদ পারভেজকে নিয়ে গোপালগঞ্জ সদরে চলে যান এবং যুদ্ধের সময় সেখানেই কন্যা তৃষা ইসলামের জন্ম দেন।
মীর আবুল কাশেমের স্ত্রী রেহানা বেগম প্রাণ বাঁচাতে ফরিদপুর চলে যান। সেখানে তিনি তাঁর সন্তান মীর আবুল কাইয়ূম, মরহুমা নাজমা সোহেলি, মীর আবুল কাওসার, নাজনীন সোহেলি, মীর আবুল কায়েস, আইভি আহমেদ ও শায়লা শামীমকে শিক্ষিত করে তোলেন। তাদের অনেককেই এখন দেশে ও বিদেশে মর্যাদাপূর্ণ অবস্থানে জীবনযাপন করছেন।
তবে, তাঁর সর্বকনিষ্ঠ সন্তান কুমকুম কাশেমের শহীদ হওয়ার কিছুদিন পরেই খাবারের অভাবে ও বিনা চিকিৎসায় মাত্র দেড় বছর বয়সে মারা যান।
মোতাবেল মিয়ার নাম মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রণালয় গেজেট অন্তর্ভুক্ত হয়েছে বেশ আগেই।
তবে আজও শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে তালিকাভুক্ত হয়নি মীর আবুল কাশেমের নাম। রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি পায়নি তাঁর আতœদান।
মীর আবুল কাশেমের পরিবার তাঁর নামটি শহীদ মুক্তিযোদ্ধা হিসেবে গ্যাজেটভুক্ত করার সুপারিশ করতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে আবেদন জানান।