দ্রুত রোহিঙ্গা প্রত্যাবাসনে মিয়ানমারকে সম্মত করার চেষ্টা করবে চীন

1190

বেইজিং, ৪ জুলাই, ২০১৯ (বাসস) : বাংলাদেশ থেকে মিয়ানমারের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে চীন দেশটির সরকারকে সম্মত করতে চেষ্টা করবে বলে বেইজিং আজ ঢাকাকে আশ্বস্ত করেছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রধানমন্ত্রী কেকিয়াংয়ের মধ্যে দ্বিপাক্ষিক বৈঠকে বেইজিং এ আশ্বাস দিয়েছে।
বৈঠকে চীনের প্রধানমন্ত্রী এই দীর্ঘস্থায়ী সমস্যা দ্রুত সমাধানে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে একমত পোষণ করে বলেন, এতে কোন সন্দেহ নেই যে এটা বাংলাদেশের জন্য একটি বড় সমস্যা।
লি কেকিয়াং এ সমস্যা দ্বিপক্ষীয় ভিত্তিতে সমাধানেও গুরুত্বারোপ করেন। তিনি বলেন, চীন এই সমস্যা সমাধানে সহায়তা করবে।
বৈঠক শেষে সাংবাদিকদের ব্রিফিংকালে পররাষ্ট্র সচিব মো. শহীদুল হক চীনের প্রধানমন্ত্রীকে উদ্ধৃত করে সাংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ ও মিয়ানমার উভয়ে চীনের বন্ধু। আমরা এর আগে রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে দু’দেশকে সহায়তা করেছি এবং আমরা আমাদের চেষ্টা অব্যাহত রাখবো।
চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, দু’দেশকে আলোচনার মাধ্যমে এই সমস্যার সমাধান বের করতে হবে।
এ প্রসঙ্গে কেকিয়াং উল্লেখ করেন যে, চীন তার পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে দু’বার মিয়ানমারে পাঠিয়েছে। আলোচনার মাধ্যমে এ সমস্যার সমাধানে প্রয়োজনে আমরা আবারো আমাদের মন্ত্রীকে মিয়ানমারে পাঠাবো।
শহীদুল হক বলেন, বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের কাঙ্খিত লক্ষ্য অর্জনে এই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, রোহিঙ্গা সংকটের কারণে এই শান্তি ও স্থিতিশীলতা বিঘিœত হচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, যতই সময় যাবে এই সমস্যা ততই বড় আকার ধারণ করবে এবং এর একমাত্র সমাধান হচ্ছে রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে প্রত্যাবর্তন।
শেখ হাসিনা বলেন, রোহিঙ্গাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমেই সমস্যার সমাধান হবে।
কেন রোহিঙ্গারা ফিরে যেতে চায় না? উল্লেখ করে তিনি বলেন, মিয়ানমারকে এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। এক্ষেত্রে বাংলাদেশের করার কিছুই নেই।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ রোহিঙ্গা প্রত্যাবর্তনে দ্বিপক্ষীয় ব্যবস্থা করেছে। আমরা এ ব্যাপারে সব ধরনের প্রয়াস চালিয়েছে। কিন্তু, রোহিঙ্গারা ফেরত যেতে চায় না। কারণ, তারা শঙ্কিত যে তাদের ওপর আবারো নৃংশসতা চালানো হবে।
এই শংকা দূর করতে এবং রোহিঙ্গারা যাতে নিরাপদে, মর্যাদা ও নিজস্ব পরিচয়ে নিজ দেশে ফেরত যেতে পারে সেজন্য অনুকূল পরিবেশ গড়ে তুলতে চীনের ভূমিকা পালনের ওপর গুরুত্বারোপ করেন শেখ হাসিনা।
তিনি বলেন, তাদের জমি-সম্পত্তির ওপর অবশ্যই তাদের অধিকার থাকতে হবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্যের প্রেক্ষিতে চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, তাঁর দেশ এটা বুঝতে পেরেছে যে রোহিঙ্গা সমস্যা হচ্ছে বাংলাদেশের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ।
চীনের প্রধানমন্ত্রী রোহিঙ্গা সংকটে মানবিক সাড়ার জন্য বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানান।

পররাষ্ট্র সচিব জানান, দ্বিপাক্ষিক আলোচনা সাধারণভাবে পাঁচটি বিষয়ের উপর অনুষ্ঠিত হয়।
এগুলো হলো অর্থনৈতিক বিকাশ এবং বাণিজ্য, প্রকল্প বাস্তবায়ন সংক্রান্ত বিষয়, বিসিআইএম বা যোগাযোগ ব্যবস্থা, ভিসা সংক্রান্ত এবং রোহিঙ্গা ইস্যু।
পররাষ্ট্র সচিব জানান, চীনা প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ায় চীনের অংশীদার হিসেবে আখ্যায়িত করেন।
লি কেকিয়াং বলেন, বাংলাদেশর সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক মূল্যবান বলে মনে করি এবং এটি আরো উচ্চ স্তরে নিতে চাই। আমাদের মাঝে একটি কৌশলগত অংশীদারিত্ব রয়েছে, আমরা আশা করি, এই সম্পর্ক আগামীতে আরো গভীর ও জোরদার হবে।
এ সময় চীনা প্রধানমন্ত্রী বাংলাদেশের উন্নয়ন অগ্রযাত্র অব্যাহত থাকার এবং এই ব্যাপারে চীনের সমর্থন অব্যাহত থাকার আশাবাদ ব্যক্ত করেন।
শেখ হাসিনা বলেন, মানুষের কল্যাণে তাঁর সরকার শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নকে অগ্রাধিকার দিয়ে থাকে।
আলোচনার শুরুতে চীনা প্রধানমন্ত্রী চতুর্থবারের মত বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী নির্বাচিত হওয়ায় শেখ হাসিনাকে অভিনন্দন জানান।
বেইজিংয়ের তিয়েনয়ানমেন স্কয়ারে পশ্চিম প্রান্তে অবস্থিত গ্রেট হল অফ পিপল এ সকাল ১১ টায় আলোচনা সভা শুরু হয়। এটি গণচীন সরকার এবং ক্ষমতাসীন কমিউনিস্ট পার্টির আইন প্রণয়ন এবং বিভিন্ন উৎসবের জন্য ব্যবহৃত হয়।
এর আগে সকাল পৌনে ১১ টায় শেখ হাসিনা গ্রেট হলে পৌঁছালে তাঁকে বর্ণাঢ্য রাষ্ট্রীয় অভ্যর্থনা জানানো হয়। এখানে চীনের প্রধানমন্ত্রী তাঁবে স্বাগত জানান এবং পর দু’দেশের প্রধানমন্ত্রী নিজ নিজ প্রতিনিধিদলের সদস্যদের সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেন।
পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীকে তিন বাহিনীর একটি চৌকষ দল গার্ড অফ অনার প্রদান করে। চীনের প্রধানমন্ত্রীকে সঙ্গে নিয়ে শেখ হাসিনা সুসজ্জিত একটি ডায়াস থেকে সালাম গ্রহণ করেন এবং গার্ড পরিদর্শন করেন।
এ সময় বাংলাদেশ এবং চীনের জাতীয় সংগীত বাজানো হয় এবং তোপধ্বনি প্রদান করা হয়।
শেখ হাসিনা ওয়াল্ড ইকোনমিক ফোরামের বার্ষিক সভায় অংশ নিতে এবং চীনের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে আলোচনা করতে পাঁচদিনের দ্বিপাক্ষিক সরকারি সফরে গত ১ জুলাই চীনে গেছেন।

অর্থনীতি ও বাণিজ্য প্রসঙ্গে চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, গত বছর বাংলাদেশ ও চীনের মধ্যে বাণিজ্যের পরিমাণ ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
জবাবে শেখ হাসিনা বাণিজ্য বৃদ্ধি ও বৈষম্য চীনের পক্ষে উল্লেখ করে দু’দেশের মধ্যে বাণিজ্য বৈষম্য দূর করার প্রয়োজনীয়তার ওপর জোর দিয়ে বলেন, ‘চীনের উচিত বাংলাদেশে আরো বেশি বিনিয়োগ করা এবং ফিরতি ক্রয়ের গ্যারান্টিসহ আরো কলকারখানা গড়ে তোলা।’
বাংলাদেশ ১শ’টি অর্থনৈতিক অঞ্চল গড়ে তুলছে উল্লেখ করে শেখ হাসিনা এসব অর্থনৈতিক অঞ্চলে চীনকে বিনিয়োগে এগিয়ে আসার আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে লী কেকিয়াং বলেন, তারা ভারসাম্যহীন বাণিজ্য সম্পর্ক চান না এবং বাণিজ্য বৈষম্য কমিয়ে আনতে কাজ করবেন বলে আশ্বাস দেন।
বর্তমানে ৯৭ শতাংশ বাংলাদেশী পণ্য চীনের বাজারে শুল্কমুক্ত প্রবেশাধিকার পাচ্ছে উল্লেখ করে চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, তারা বাকি ৩ শতাংশ পণ্যের শুল্কও ছাড় দেয়ার চেষ্টা করবে।
তিনি বলেন, চীন নিবিড়ভাবে এফটিএ সম্ভব সমীক্ষার ফল মনিটর করছে।
প্রকল্প বাস্তবায়ন ইস্যু প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ২০১৬ সালে চীনের প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশ সফরকালে ঢাকা বেইজিংয়ের সঙ্গে বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রকল্প বাস্তবায়নে বেশকিছু চুক্তি ও সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করে।
তিনি এসব প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া গতিশীল করার ওপর গুরুত্বারোপ করেন।
প্রধানমন্ত্রী চীনের প্রতি ঋণচুক্তির শর্তাবলী সহজ করার এবং প্রকল্প বাস্তবায়নে সঠিক সময়ে তহবিল ছাড়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান।
এ প্রসঙ্গে চীনের প্রধানমন্ত্রী বলেন, চীন বিষয়টি বিবেচনা করবে।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ বাস্তবায়ন, একটি জলবায়ু অভিযোজন কেন্দ্র স্থাপন এবং তিস্তা নদী সার্বিক ব্যবস্থাপনা ও পুনরুদ্ধার প্রকল্প বাস্তবায়নে সম্পদ সংগ্রহে চীনের সহযোগিতা কামনা করেন।
এছাড়া তিনি ঢাকা-চট্টগ্রাম-কক্সবাজার দ্রুতগামী ট্রেন যোগাযোগ প্রকল্প বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া গতিশীল করতেও চীনের সহায়তা কামনা করেন।
ভিসা ইস্যু প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, বাংলাদেশ ‘অন অ্যারাইভেল ভিসা’ ব্যবস্থার আওতায় চীনের নাগরিকদেরকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে ভিসা প্রদান করে থাকে। কিন্তু চীন ভ্রমণকারী বাংলাদেশী নাগরিকদের একই সুবিধা দেয়া হয় না।
তিনি আশা প্রকাশ করেন যে, চীন বাংলাদেশী পাসপোর্টধারী বিশেষ ছাত্র ও ব্যবসায়ীদের জন্য ভিসা প্রক্রিয়া সহজ করবে।
বিসিআইএম অর্থনৈতিক করিডোর প্রসঙ্গে দুই প্রধানমন্ত্রী এ অঞ্চলের বাজারগুলোকে সংযুক্ত করতে এর গুরুত্ব ও সম্ভাবনা তুলে ধরে বলেন, উভয় দেশ বিসিআইএম করিডোর দ্রুত বাস্তবায়নে সম্মত।
চীনে বাংলাদেশের রাষ্ট্রদূত মো. ফজলুল করিম ও প্রধানমন্ত্রীর ভাষণ লেখক মো. নজরুল ইসলাম ব্রিফিংয়ে উপস্থিত ছিলেন।
অটিজম এন্ড নিউরো-ডেভেলপমেন্ট ডিজঅর্ডারস-এর জাতীয় উপদেষ্টা কমিটির চেয়ারপারসন সায়মা ওয়াজেদ হোসেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রী ড. এ কে আবদুল মোমেন, প্রধানমন্ত্রীর বেসরকারি শিল্প ও বিনিয়োগ বিষয়ক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী মো. শাহরিয়ার আলম ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় বিষয়ক সংসদীয় স্থায়ী কমিটির সভাপতি মো. ফারুক খান দুই প্রধানমন্ত্রীর মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকের সময় বাংলাদেশ পক্ষে উপস্থিত ছিলেন।
পরে প্রধানমন্ত্রী ‘দ্য গ্রেট হল অব দ্য পিপল’-এ চীনের প্রধানমন্ত্রীর দেয়া এক ভোজসভায় যোগদান করেন।