দুগ্ধ খামারীদের গ্রাম পীরগঞ্জের কাশিমপুর

784

রংপুর, ২ জুলাই, ২০১৯ (বাসস): জেলার পীরগঞ্জ উপজেলার কাশিমপুর গ্রাম দুগ্ধ খামারীদের গ্রাম হিসাবে পরিচিতি পেয়েছে। উপজেলার পূর্ব উত্তরের ৪ কিলোমিটারের সড়কপথে মিঠিপুর ইউনিয়নে কাশিমপুর গ্রামের অবস্থান। এ গ্রামে প্রায় ২০০০ লোকের বসবাস। গ্রামের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে এলাকার প্রান্তিক চাষি, বেকার যুবক ও মহিলাদের মাধ্যমে দুগ্ধ খামার গড়ে উঠেছে। ছোট বড় মিলে প্রায় ৭৪টি দুগ্ধ খামার রয়েছে ওই গ্রামে।
সরেজমিনে দেখা গেছে, কাশিমপুর গ্রামে ঢুকতেই চোখে পড়ে শুধু গরুর খামার। দেশি-বিদেশি বিভিন্ন প্রজাতির গরু-বাছুরে গ্রামটি ভরপুর। দেখলে মনে হবে এটি যেন গ্রাম নয়, গোচারণ ভূমি। নারী-পুরুষ সকলে রয়েছে গরুর সেবায় ব্যস্ত। কেউ কাটছে ঘাস, কেউ বিচালি (খড়), আবার কেউবা গরুর গা ধোয়াচ্ছেন। কথা বলার সময় নেই, গরুর পরিরর্চায় ব্যস্ত সবাই। কারণ সময়মতো দুধ নিয়ে যেতে হবে কারখানায়। দুধ নিয়ে কেউ যাচ্ছে বাইসাইকেলে, কেউ যাচ্ছেে মাটর সাইকেলে, কেউ যাচ্ছে ভ্যানে, কেউ যাচ্ছে নছিমন-করিমনে। পরিবারের প্রায় সব সদস্যই খামারের সঙ্গে জড়িত। কাশিমপুর গ্রামের মানুষের প্রধান কাজ কৃষি ও গরু পালন।
উপজেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তরের তথ্যমতে, খামারগুলোতে ফ্রিজিয়ান, শাহিওয়াল, হলেস্টান, জার্সিসহ বিভিন্ন জাতের গরু রয়েছে। এর মধ্যে ফ্রিজিয়ান গরুর সংখ্যা বেশি, ২/৪টি জার্সি রয়েছে। কাশিমপুর গ্রামে যত গরিব পরিবারই থাকুক না কেন তাদের কমপক্ষে ৩ থেকে ৪টি গরু রয়েছে। অবস্থাসম্পন্ন পরিবারের রয়েছে ৫ থেকে ৫০টির অধিক গরু। প্রতিদিন ৩০০ লিটার দুধ বিক্রি করেন এমন পরিবারও আছেন এ গ্রামে। সব মিলিয়ে এখানে প্রতিদিন ৫ হাজার লিটার দুধ উৎপাদন হচ্ছে। যা পীরগঞ্জ ও পলাশবাড়ি উপজেলার ব্রাক সেন্টার, মিল্ক ভিটা, স্থানীয় হোটেলসহ বিভিন্ন জায়গায় বিক্রি করা হয়। সকালের চেয়ে বিকেলের দুধের দাম তুলনামুলক বেশি পায় খামারিরা। নিজস্ব তত্ত্বাবধানে প্রতিদিন সকালে ও বিকেলে ক্রেতার নিকট দুধ পৌঁছে দিতে হয় খামারিদের। গো-খাদ্যের জন্য খামারিদের প্রায় ১৪ একর জমিতে রোপিত আছে হাইব্রিড নেপিয়ার, পাকচং ঘাস ও ভুট্টা। সেখান থেকে ঘাস কেটে খাওয়ানো হয়।
কাশিমপুর গ্রামের খামারি চাঁন মিয়া, শেখ সাদি, জাবেদ আলী, কাদের মিয়া, ডিপটি মিয়া, দেলদার হোসেনসহ অনেকের সাথে কথা হয়। খামারি চাঁন মিয়া বাসসকে জানান, ২০০৭ সালে ১টি ফ্রিজিয়ান জাতের গাভী দিয়ে খামার শুরু করেন। বর্তমানে ১৬ টি গাভী ও ১২ টি বকনা বাছুর রয়েছে তাঁর খামারে। প্রতিদিন প্রায় ২০০ লিটার দুধ বিক্রি করেন চাঁন মিয়া। প্রতি লিটার দুধ ৩৫/৪০ টাকা দরে বিক্রি হয়। কাশিমপুর গ্রামে ব্রাকের বি.পি.এফ.পি দুগ্ধ ক্রয় কেন্দ্র এবং স্থানীয় যুবক আশরাফুল ইসলামের দুগ্ধ ক্রয় কেন্দ্রে বিক্রি করেন তিনি। নিজের ২ একর জমিতে হাইব্রিড নেপিয়ার ঘাস লাগিয়েছেন। প্রতিদিন সাড়ে তিন থেকে ৪ হাজার টাকা খাদ্য ক্রয় করতে হয় তাকে। এর পরেও তার মাসে এক লক্ষ টাকা বাড়তি আয় হয়ে থাকে। দুই ছেলে এক মেয়ে সন্তান নিয়ে তার সংসার। ওই খামারের আয় থেকে তিনি মেয়ে সাকিলাকে কালসারডারা বাজারে বিয়ে দিয়েছেন। মেয়ে জামাই সুখে আছেন। দুই ছেলে বড় ছেলে শাহিন বয়স ২৫ বছর বিয়ে করেছেন। ছোট ছেলে স্বাধীন বয়স ১২ বছর ৬ষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ে। স্ত্রী শাহানারা বেগমসহ সকলে মিলে খামার দেখাশুনা করেন। ওই খামার করার পর থেকে সকলকে ব্যস্ত সময় পার করতে হয় তাদের।এ খামারের আয় থেকে ২ একর জমি ক্রয় এবং আড়াই একর জমি বন্ধক নিয়েছেন চান মিয়া। নতুন বাড়ি ঘরও করেছেন তিনি। দুগ্ধ খামার করে কাশিমপুর গ্রামের চাঁন মিয়ার মত ভাগ্য বদল হয়েছে ছাদেক আলী, ওয়াজেদ আলী, আইয়ুব আলী, জাভেদ মিয়া, সবুর আলী, মূছা মিয়া, ইছা মিয়া, ইলিয়াছসহ অনেক পরিবারের। যারা এক সময় পরিবারের সদস্যদের দুমুঠো ভাত যোগাতে হিম শিম খেতেন সে পরিবার গুলো এখন স্বাবলম্বি। পরিবর্তন ঘটেছে তাদের কর্মের পরিবর্তন ঘটেছে পরিবারের। এ খামারীদের চিকিৎসা সেবা থেকে শুরু করে সব ধরনের পরামর্শ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন পীরগঞ্জ উপজেলা প্রাণী সম্পদ দপ্তর। ওই দপ্তরের কর্মকর্তাদের উপদেশ ক্রমে অনেকেই গাভী পালনের আগ্রহী হয়ে উঠে।
উপজেলা প্রাণী সম্পদ কর্মকর্তা ডা: মো: তাজুল ইসলাম জানান, উপজেলা নিভূত গ্রামেও নেপিয়ার জাতের ঘাস চাষের পাশাপাশি গাভী পালনের ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষদের উৎসাহীত করা হয়। তার ফল এখন অনেকেই পাচ্ছেন। গ্রামের মানুষ একদিকে খামারে উন্নত জাতের গাভী পালন করে দুগ্ধ সংগ্রহ করে দেশের চাহিদা মেটাচ্ছেন। অন্যদিকে তারা গো খামার করে স্বনির্ভর হয়ে উঠছেন। এতে দেশের দারিদ্র দুরীকরণ সম্ভব হচ্ছে। একই সাথে দেশের পুষ্টির চাহিদাও মিটাতে তারা অগ্রনী ভূমিকা পালন করছেন।