কৃষি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে পড়ছে পঞ্চগড়ের কৃষকরা

482

॥ জাকির হোসেন কবির ॥
পঞ্চগড়,২৯জুন, ২০১৯(বাসস): দেশের ৮০ ভাগ মানুষ কৃষি নির্ভর। অপরিকল্পিত নগরায়ন, শিল্পায়ন এবং বসতবাড়ী করার কারণে প্রতিনিয়তই কমছে কৃষি জমির পরিমাণ। তবে আশার ব্যাপার হল যে, জমি কমলেও আবাদ কমছে না। এর কারণ হল কৃষকরা যুগের সাথে তাল মিলিয়ে তাদের জমি চাষাবাদ করছে। কৃষিতে এসেছে বৈচিত্র। একটি জমিতে আগে যেখানে দু’টি ফসল হতো এখন সেখানে হচ্ছে চারটি ফসল। এসব জমিতে বিভিন্ন ফসল আবাদ করে কৃষকরা দেশের চাহিদা মেটাচ্ছে। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্য এখন যাচ্ছে বিদেশেও। ফসলের উৎপাদন খরচ কমাতে মান্ধাতা আমলের নিয়ম বাদ দিয়ে পঞ্চগড়ের কৃষকরা এখন চলে এসেছে যান্ত্রিক যুগে। বিশেষ করে জমি চাষ ও ফসল মাড়াইয়ে তারা নির্ভর হয়ে পড়েছে যন্ত্রের ওপর। ফসল কাটা আর জমিতে বীজ ও রোপা লাগানোর যন্ত্রের ব্যবহারও শুরু হয়েছে ইতোমধ্যে।
দেশের অর্থনীতি কৃষি নির্ভর হলেও সময়মত নিত্য নতুন কৃষি প্রযুক্তি গ্রহণ না করায় অনেক পিছিয়ে পড়েছে কৃষকরা। উৎপাদিত ফসলের ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় বার বার লোকসান গুনে কৃষি থেকে সরে আসতে শুরু করে কৃষকরা। মান্ধাতা আমলের মত গুরু দিয়ে চাষাবাদ, শ্রমিক দিয়ে ফসল কাটা-মাড়াই করতে উৎপাদন খরচ অনেক বেড়ে যায়। সেই সাথে রয়েছে শ্রমিকের চরম সংকট। কাজের সময় বেশী পারিশ্রমিক দিয়েও শ্রমিক পাওয়া যায়না। এসব কারণে কৃষিতে অনীহা আসে কৃষকদের। অনেক বড় কৃষক তাদের জমি চুক্তিতে ছেড়ে দেয় ছোট ও প্রান্তিক কৃষকদের কাছে। কিন্তু আশার ব্যাপার হলো, কৃষিতে উন্নত দেশের ব্যবহৃত যন্ত্র বাংলাদেশের কৃষকরা ব্যবহার শুরু করায় ফসলের উৎপাদন খরচ অনেক কমে যাচ্ছে। তাই কৃষি থেকে সরে আসা কৃষকরা আবারও ফিরে এসেছে কৃষিতে। বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, এখন আর গরুর হালের লাঙ্গল খুঁজে পাওয়া যায়না। গো-খাদ্য সংকটের কারণে অনেক কৃষকই এখন আর গরু পালন করে না। আর গরুর সংকটের কারণে কৃষকদের নির্ভর করতে হয় যান্ত্রীক হালের ওপর। কয়েক বছর আগে গরুর হালের বিপরীতে কৃষকরা পাওয়ার টিলার দিয়ে জমি চাষ করত। এখন পাওয়ার টিলারও প্রায় উঠে যাচ্ছে। কম সময়ে অনেক জমি চাষের জন্য এখন জনপ্রিয় ট্রাক্টর। মাত্র তিনশ’ টাকা দিয়ে এক বিঘা জমি চাষ করে নিতে পারছে কৃষকরা। চলতি রোপা আমন মৌসূমে দেখা গেছে, ট্রাক্টর চালকরা দিনে-রাতে জমি চাষ করছে।
কৃষকরা জানিয়েছে, এক বিঘা জমিতে রোপা আমনের চারা লাগাতে দুই চাষ দিলেই যথেষ্ট। সেখানে খরচ পড়ে মাত্র ছয়শ’ টাকা। আর এক বিঘা জমিতে গরুর হাল দিয়ে চার চাষ দিতে হয়। সাথে জমি সমান করতে দিতে হয় মই। এতে খরচ হয় প্রায় দুই হাজার টাকার মত। অনেক অবস্থাসম্পন্ন কৃষক নিজেরাই ট্রাক্টর কিনেছে। নিজের জমি চাষ করে মৌসূমে তারা অন্যের জমি চাষ করে। বাকি সময়টাতে তারা ট্রাক্টরে ট্রলি লাগিয়ে মালামাল পরিবহণ করে। আবার ফসল মাড়াইয়েও এখন কৃষকদের একমাত্র অবলম্বন যন্ত্র। ধান, গম, ভূট্টাসহ বিভিন্ন ফসল এখন মাড়াই হচ্ছে যন্ত্রের সাহায্যে। এতে করে যেমন খরচ কমছে তেমনি সময়ও লাগছে অনেক কম। এখনও ব্যাপকভাবে না হলেও গত দুই-তিন বছর থেকে যন্ত্রের সাহায্যে ফসল কাটা হচ্ছে। বীজ বপন ও রোপা লাগানোর যন্ত্রও ব্যবহার করছেন কেউ কেউ। আগামী দিনগুলোতে এসব যন্ত্রের ব্যবহার আরও বাড়বে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছে কৃষকরা। এসব যন্ত্র ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ প্রায় অর্ধেকে নেমে এসেছে। উৎপাদন খরচ কমাতে এসব কৃষি প্রযুক্তি এখন সাদরে গ্রহণ করছে কৃষকরা। এখন চাকুরী না পেয়ে অনেক শিক্ষিত বেকার যুবকও নামছে কৃষিতে। সাফল্যও আসছে অনেকের। এরকম একজন উচ্চ শিক্ষিত বেকার যুবক আব্দুর রাজ্জাক। কয়েক বছর থেকে কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে ঈর্ষনীয় সাফল্য এনেছেন তিনি। নিজের জমি চাষ করে ফসল উৎপাদন করে প্রতি বছর খরচ বাদ দিয়ে তিনি আয় করছেন কয়েক লাখ টাকা। তিনি ওই এলাকায় একজন অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। তার দেখাদেখি এখন অনেক বেকার যুবক নেমেছেন কৃষিতে। কারও নিজের জমি না থাকলেও অন্যের জমি চুক্তিতে নিয়ে ফসল আবাদ করছেন। রাজ্জাক জানান ,তিন একর জমি নিয়ে চাষাবাদ শুরুকরেন। আধুনিক কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহার করে দেখলেন এতে অনেক লাভ রয়েছে। ওই জমিতে বর্ষায় আমন ধান আবাদের পর শুস্ক ও শীত মৌসূমে রসুন, ভূট্টা, হাইব্রিড জাতের টমেটো, তরমুজ, মিষ্টি কুমড়াসহ অন্যান্য ফসল আবাদ শুরুকরে। চাষের জন্য ব্যবহার করে ট্রাক্টর, পানি দেয়ার জন্য স্যালো মেশিন। ফসল মাড়াই করে যন্ত্রের সাহায্যে। এতে আগের চেয়ে উৎপাদন খরচ অনেক কমে গেল। অন্যদের চেয়ে আমার ফসল উৎপাদন হল অনেক বেশী। এখন দেখছি চাকুরী করে আমি যে বেতন পেতাম তার চেয়ে বেশী আয় করছি কৃষিকাজ করে ।
পঞ্চগড় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক আবু হোসেন বাসসকে জানান, আমাদের কৃষি বিভাগ সব সময় কৃষি প্রযুক্তি ব্যবহারে কৃষকদের উৎসাহিত করে আসছে। উপ সহকারী কৃষি কর্মকর্তারা কৃষকদের বাড়ি বাড়ি গিয়ে এ ব্যাপারে পরামর্শ দিয়ে আসছেন। সরকার কৃষি যন্ত্রপাতি ক্রয়ে কৃষকদের বিশেষ প্রণোদনা দিয়ে আসছে। এ কারণে কৃষিতে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে। তিনি আরও বলেন, অন্যান্য জেলার মত পঞ্চগড়ের কৃষকরাও এখন কৃষি প্রযুক্তি নির্ভর হয়ে উঠছে। এসব প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে ফসলের উৎপাদন খরচ অনেক কমে আসছে। জমি চাষ, মাড়াইসহ কৃষিকাজে অধিকাংশ কৃষক এখন যন্ত্রের ওপর নির্ভর। আগামীতে ব্যাপকভাবে ধান কাটা ও বীজ বপন-রোপণের কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রের ব্যবহার শুরু হলে উৎপাদন খরচ আরও অনেক কমে আসবে বলে তিনি জানান।