বাজিস-২ : ভোলায় জেলেরা বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে

224

বাজিস-২
ভোলা-জেলে-স্বাবলম্বী
ভোলায় জেলেরা বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হচ্ছে
॥ হাসনাইন আহমেদ মুন্না ॥
ভোলা, ২৩ জুন, ২০১৯ (বাসস) : জেলায় জেলেদের বিকল্প কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে গড়ে তোলা হচ্ছে। ২০১৬ সাল থেকে আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়ার্ল্ডফিশের ইকোফিশ প্রকল্প’র মাধ্যমে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ দিয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করছে জেলেদের। অসহায় জেলেদের মাঝে বিনামূল্যে গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগী শাক-সবজি’র বীজ ও হস্তশিল্পের সরঞ্জাম প্রদানসহ আত্মনির্ভরশীল করা হচ্ছে। ফলে এসব জেলেরা নদীতে মৎস্য শিকারে সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা নদীতে মাছের আকালে অভাবে থাকছে না। এছাড়াও বিভিন্ন এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে টাকা ধার নেয়াও বন্ধ হয়েছে। এখন তারা বিকল্প আত্ম কর্মসংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী হওয় উঠেছে।
জানা যায়, ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ ধরার প্রতি সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা নদীতে মাছ কম ধরা পড়লে অভাব অনটনে দিন কাটাতো জেলেরা। অনেকে মহাজন ও এনজিওর থেকে ঋণের টাকা পরিশোধের ভয়ে বাড়ি-ঘর ছেড়ে পালিয়ে বেড়াতো। বর্তমানে প্রকল্পটি চালু হওয়ার পর থেকে নদীতে অভিযান ও মাছ কম পড়লে ধার করা টাকা পরিশোধের ভয়ে পালাতে হচ্ছেনা জেলেদের।
ইকোফিশ প্রকল্পের প্রকল্প সহ-সমন্বয়কারী সোহেল মাহমুদ বাসস’কে বলেন, ভোলা জেলায় আমরা বর্তমানে সাড়ে ৭ হাজার জেলে নিয়ে কাজ করছি। তাদের মান উন্নয়নে উন্নত প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। এদের মধ্যে বছরে দুই বার বিনামূল্যে সাক-সবজির বীজ, গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস, মুরগী বিতরণ করা হচ্ছে।
তিনি বলেন, সরকারি নিষেধাজ্ঞা কালিন সময় জেলেরা যাতে নদীতে মাছ ধরতে না যায় সেজন্য জেলায় ১১৬ জন জেলেকে মাসিক বেতনে কমিউটিনি ফিশ ঘট হিসেবে নিয়োগ দেয়া হয়েছে। এছাড়াও জেলেরা যাতে মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ না নেয় সেজন্য জেলেদের পরিবারের নারী সদস্যদের নিয়ে জেলায় ৩৭টি মৎস্যজীবি নারী কল্যাণ তহবিল গঠন করে প্রত্যেকটির তহবিলে ২৫ হাজার টাকা করে মূলধন প্রদাণ করা হয়। বর্তমানে ওই তহবিলে প্রায় ৩০ লাখ টাকা মূলধন রয়েছে।
ওয়ার্ল্ডফিশ সংস্থার রির্সাস এ্যাসোসিয়েড অংকুর মোহাম্মদ ইমতিয়াজ বাসস’কে বলেন, আমরা দরিদ্র জেলে ও তাদের পরিবারকে স্বাবলম্বী করার জন্যই মূলত কাজ করছি। বিভিন্ন কর্মসূচির মাধ্যমে আমরা তাদের অভাব দূর করে আত্ম-কর্মসংস্থানের মাধ্যমে বিকল্প আয়ের পথ সৃষ্টি করছি। জেলেদের উপকরণ বিতরণের পাশাপাশি তদারকি করার জন্য মাঠ পর্যায়ে আমাদের কর্মকর্তারা কাজ করছে।
মোহাম্মদ ইমতিয়াজ আরো বলেন, বর্তমানে এসব জেলেরা স্বনির্ভরতা অর্জন করেছে। তারা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নেয় না। এছাড়াও মৎস্য শিকারে নিষেধাজ্ঞার সময় জেলে ও তাদের পরিবারের সদস্যদের নিয়ে বিভিন্ন ক্রীড়া ও সাংকৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করে থাকি। যা তাদের কাজে বাড়তি উদ্যোম যোগায়।
সরেজমিনে জেলেদের সাথে আলাপ কালে জানা গেছে, ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীর মাছ শিকার করে জীবিকা নির্বাহ করে প্রায় সাড়ে ৩ লাখ জেলে। তবে সরকারি নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা ১ লাখ ৩২ হাজার ২৬০ জন। নিবন্ধন থাকলেও সবার ভাগ্যে জোটেনা সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত চাল। সরকারিভাবে বরাদ্দকৃত চাল পাচ্ছে মাত্র ৫১ হজার ১৫০ জন। ফলে অনেক জেলে সরকারি নিষেধাজ্ঞা বা নদীতে মাছ কম পড়লে বিভিন্ন এনজিও ও মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে চলতে হয়। এসব গরিব জেলেদের বিকল্প কর্ম সংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী গড়ে তুলতে কাজ করে যাচ্ছে এ প্রকল্প।
ভোলা সদরের ধনিয়া ইউনিয়নের নাছির মাঝি এলাকার মেঘনা নদীর জেলে মোঃ ফিরোজ বলেন, এক সময় অনেক দুঃখ কষ্টে জীবন কাটাতাম। মাছ ধরা বন্ধ থাকলে দু’বেলা ঠিক মত খেতে পারতাম না। দেনার ভয়ে পালিয়ে থাকতে হতো। ইকোফিশ প্রকল্পের আসার পর আমাদের তারা প্রশিক্ষণ প্রদান করে গরু, ছাগল, ভেড়া, হাঁস-মুরগী ও সবজির বীজ দিয়েছে। এখন মাছ ধরা বন্ধ থাকলে বা নদীতে মাছ না পারলে অভাবে থাকিনা। অনেক ভালো আছি।
একই এলাকার শাহানাজ বেগম বলেন, আমার স্বামী একজন জেলে। নদীতে মাছ ধরে আমাদের সংসার চলে। একসময় অনেক কষ্টে ছেলে মেয়ে নিয়ে দিন কাটাতাম। আমি ইকোফিশ থেকে প্রশিক্ষণ নিয়ে হস্ত শিল্পের কাজ করছি। প্রথমে তারা আমাদের সরঞ্জাম দিয়েছিল। হস্তশিল্পের কাজ করে স্বাবলম্বী হয়েছি। এখন আর নদীর ওপর আমাদের নির্ভর করতে হয় না।
তুলাতুলি এলাকার বশির মাঝি বলেন, নদীতে মাছ ধরতে পারলে আগে ভাত খেতে পারতাম আর না ধরতে পারলে না খেয়ে থাকতাম। কিন্তু এখন সেই দিন নেই। জেলে পেশার পাশাপাশি বিকল্প কর্ম সংস্থানের মাধ্যমে শাক-সবজি, গরু, ছাগল পালনে জীবন অনেক ভাল করে চালাচ্ছি।
ভেদুরিয়া ইউনিয়নের মধ্য ভেদুরিয়া গ্রামের জোসনা বেগম বলেন, ইকোফিশ বিভিন্ন ধরণের সাবজির বীজ, গরু, ছাগল, ভেড়ার পাশাপাশি আামাদের নারীদের জন্য মৎস্য জীবি নারী কল্যাণ তহবিল সমিতির গঠন করেছে। প্রথমে ইকোফিশ আমাদের ২৫ হাজার টাকা দেয়। আমরা নিজেরা নিজেদের টাকা জমা রাখি। বর্তামানে আমরা মাছ ধরা বন্ধ থাকার সময় টাকার প্রয়োজন হলে নিজেরা নিজেদের মধ্যে সমিতির নিয়ম অনুযায়ী ঋণ নেই। এখন আর মহাজন কাছ থেকে চড়া সুদে ও এনজিওর কাছ থেকে ঋণ নিতে হয় না।
সদর উপজেলার সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা মোঃ আসাদুজ্জামান বাসস’কে বলেন, আমাদের মৎস্য অধিদপ্তরের সহযোগিতায় আন্তর্জাতিক সংস্থা ওয়াল্ডফিশের ইকোফিশ প্রকল্পটি জেলেদের বিকল্প কর্ম সংস্থানের মাধ্যমে স্বাবলম্বী করে তুলছে। এতে অনেক জেলে পরিবারের ভাগ্য পরিবর্তন হয়েছে। এছাড়া এ প্রকল্পের কারণে জেলেরা পূর্বের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন হয়ে হয়েছে। পরিবর্তন এসেছে তাদের সার্বিক জীবন মানের।
বাসস/এইচএএম/১৩১০/-নূসী