বাসস ইউইনসেফ ফিচার-২ : শিশুদের সুষম খাবার প্রয়োজন

140

বাসস ইউইনসেফ ফিচার-২
শিশু-সুষম খাবার
শিশুদের সুষম খাবার প্রয়োজন
॥ মুসলিমা খাতুন ॥
ঢাকা, ১০ জুন, ২০১৯ (বাসস) : ময়মনসিংহের সার্কিট হাউজের পাশ দিয়ে বয়ে চলছে ব্রহ্মপুত্র নদ। তার পাশেই গড়ে উঠেছে ছোট্ট পার্ক। সেখানে ফুসকা আর চটপটির দোকানে কাজ করে একটি মেয়ে। বয়স আনুমানিক ১২/১৩ বছর। নাম জিজ্ঞাসা করতেই মিষ্টি হেসে উত্তর দেয় ‘সুমি’। চার ভাই বোনের মধ্যে সুমি সবার বড়। বাবা রিক্সা চালিয়ে যে আয় করে তা দিয়ে তাদের সংসারের খরচ চলে না। তাই, লেখাপড়া বন্ধ করে চটপটির দোকানে কাজ করে যে সামান্য আয় করে তা সন্ধ্যার পরে তুলে দেয় মায়ের হাতে। বড় ইচ্ছা ছিল একদিন লেখাপড়া শিখে অনেক বড় অফিসে চাকরি করবে। বাবা-মা আর ভাই-বোনদের মুখে হাসি ফুটাবে একদিন। কিন্তু বাস্তবতার কাছে হার মেনে নিজেকে এখন মানিয়ে নিয়েছে কাজের সাথে। কিন্তু অপুষ্ট তার শরীরে ক্লান্তির চিহ্ন বেশ স্পষ্ট হয়ে ধরা দিচ্ছে।
আমাদের দেশে অপুষ্টির প্রধান কারণগুলো হচ্ছে- অধিক জনসংখ্যা, দারিদ্র, পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা ও অসচেতনতা। অধিক জনসংখ্যা যে দেশে, সেখানে পরিবেশ দুষিত হওয়ার আশঙ্কা বেশি। কারণ, অল্প জায়গার মধ্যে অনেক লোকের বসবাসের ফলে নোংরা পানি, আবর্জনায় ভরপুর পথঘাট স্বাস্থ্যহানি ঘটায়। এছাড়া অধিক জনসংখ্যার কারণে খাদ্যদ্রব্যের সহজলভ্যতাও কমে যায়। ফলে, কিশোর কিশোরীরা স্বাভাবিক পুষ্টি থেকে বঞ্চিত হয়। আর্থিক কারণে প্রয়োজনীয় খাবার খেতে না পারায় অপুষ্টির শিকার হয়। আবার যে পরিবারে অর্থের সমস্যা নেই, সেই পরিবারের ছেলেমেয়েরাও অতিরিক্ত পরিমানে জাঙ্কফুড খাওয়ায় অপুষ্টির শিকার হতে পারে। পুষ্টি সম্পর্কে অজ্ঞতা যেমন- বয়স অনুপাতে কতটুকু খাবার, কি খাবার, কত সময় পর পর খেতে হবে, তা অনেক মা-বাবাই জানেন না। এখানে সুষম খাবারের ঘাটতি দেখা যায়। অপুষ্টি দূর করতে হলে সুষম খাবার খেতে হবে। এটা শুধু কিশোর-কিশোরী নয়, সব বয়সের মানুষের জন্য প্রযোজ্য।
সম্প্রতি ১৪৮টি দেশের তথ্য নিয়ে ‘কম ওজনের শিশু জন্মের হিসাব: মাত্রা ও প্রবণতা, ২০০০ থেকে ২০১৫ শীর্ষক একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে। এতে দেখা যায়, বিশ্বের যে পাচঁটি দেশে কম ওজন নিয়ে বেশি শিশু জন্মায়, তার একটি বাংলাদেশ। সারা বিশ্বের গড়ে প্রতি সাতটি শিশুর মধ্যে একটি শিশু কম ওজন নিয়ে জন্মায়। আর বাংলাদেশে জন্ম নেয়া চারটি শিশুর একটি কম ওজনের। কম ওজনের শিশু বলতে জন্মের সময় আড়াই কেজির কম ওজনকে বোঝানো হয়েছে। বিশ্বের ২৮ কোটি ১০ লাখ শিশু জন্মের তথ্য বিশ্লেষণ করে গবেষণাটি প্রকাশিত হয়েছে। গবেষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে কম ওজনের শিশু জন্মের হার কমেছে। ২০০০ সালে এটি ছিল ৩৬ দশমিক ২ শতাংশ। ২০১২ সালে কমে দাড়িয়ে ২৯ শতাংশ এবং ২০১৫ সালে ২৭ দশমিক ৮ শতাংশ হয়েছে। গবেষকদের মতে জন্মগ্রহণ কালে শিশুর ওজন আড়াই কিলোগ্রামের কম হওয়ার বিষয়টির সঙ্গে নবজাতকের উচ্চ মৃত্যুহার ও পরবর্তী সময়ে খারাপ স্বাস্থ্যের অধিকারী হওয়ার ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক রয়েছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, অপুষ্টির কারণে কিশোর-কিশোরীরা শারীরিক ও মানসিক উভয় ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে। রক্তস্বল্পতা, মুখের কোনায় ঘা, পেটের অসুখ, রক্ত আমাশয়, টাইফয়েড, নিউমোনিয়া, বিভিন্ন ধরণের চর্মরোগ, চোখের অসুস্থতা, চুল পড়া, পেটে কৃমি, দুর্বলতা, শারীরিক গঠন সুষ্ঠু না হওয়া ইত্যাদি শারীরিক ক্ষতির সম্মুখিন হতে পারে। এছাড়া অপুষ্টির কারণে কিশোর কিশোরীর বিকাশ সঠিকভাবে হয় না। তার স্নায়ুতন্ত্রের বিকাশ পরিপুর্ণভাবে ঘটে না। বুদ্ধিগত বিকাশও বাধাগ্রস্থ হয়। ফলে বড় হলে সেই কিশোর বা কিশোরী মেধাবী হতে পারে না। এ কারণে জাতীয় প্রবৃদ্ধিতেও এর প্রভাব পড়তে পারে।
অনেকেরই ধারনা বেশি বেশি দুধ ও মাংস খেলে স্বাস্থ্য ভালো হয়। কিন্তু ধারণাটি ঠিক নয়। প্রতিটি মানুষেরই সুষম খাবার অর্থাৎ খাদ্যের সব কয়টি উপাদানের উপস্থিতি খাবারে থাকতে হবে, এমন সব খাবার খাওয়া উচিত। সে জন্য মাংস ও দুধের পাশাপাশি মাছ, ডিম, ডাল, ভাত, রুটি, সবজি, ফলমুল সবই খেতে হবে। এ ছাড়া বিশেষ কোনো একটি খাবার বেশি বেশি খাওয়া ভালো নয়। কিশোরী মায়েদের মাতৃত্ব সম্পর্কে জ্ঞান ও অভিজ্ঞতা না থাকার ফলে তার গর্ভধারণ হলে শিশুটির অপুষ্টি হওয়ার ঝুঁকি বাড়ছে বলে অনেকে মনে করেন।
সার্বিকভাবে দেশের কিশোর কিশোরীদের অপুষ্টি দূর করতে ব্যাপক উদ্যোগ এখন থেকেই গ্রহণ করা প্রয়োজন। শিশুদের মায়ের বুকের দুধ খাওয়ানো, উপযুক্ত সম্পুরক খাবার খাওয়ানো, ছয় মাস অন্তর অন্তর ভিটামিন ‘এ’ খাওয়ানো-এই কার্যক্রম বাড়াতে হবে। শিশু বয়স থেকেই এটা করতে হবে। তাহলে শিশুরা অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা সম্ভব হবে। কিশোর বয়সে অপুষ্টির শিকার কম হবে। ভাতের পাশাপাশি পর্যাপ্ত পরিমাণে ডাল, শাকশব্জি, দেশীয় ফলের চাষ বাড়াতে হবে। সমাজ থেকে অপুষ্টি দূরীকরণ কার্যক্রমে অংশগ্রহণের জন্য সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, এনজিওসহ সমাজের সকল স্তরের জনগণকে এগিয়ে আসতে হবে। তবেই সুমিদের মতো এদেশের হাজারো শিশুকে অপুষ্টির হাত থেকে রক্ষা করা যাবে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/মুখা/আরজি/১৭০৮/আহো/-এসএইচ