বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : দেশে ক্রমেই বাড়ছে এইডস রোগীর সংখ্যা

176

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
এইডস-বাড়ছে
দেশে ক্রমেই বাড়ছে এইডস রোগীর সংখ্যা
ঢাকা, ৪ জুন ২০১৯ (বাসস) : আয়শা (ছদ্ম নাম) বয়স এখন ৩১। মাত্র পনের বছর থেকে ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত বিভিন্ন হোটেলে যৌনকর্মীর কাজ করেছেন। সাত বছর বয়সেই মর্মান্তিক এক সড়ক দুর্ঘটনায় হারায় বাবা-মা আর একমাত্র ভাইকে। পরিবারের সবাই মারা যাওয়ার পর দাদীর কাছে ছিলেন তিন বছর। কিন্তু দাদী মারা যাওয়ার পর থেকে আয়শার জীবনে নেমে আসে চরম বিপর্যয়। চাচা-চাচীর সংসারে সারাদিন কাজ করতে হত। সাথে প্রতিদিন জুটত অল্প খাওয়ার। আর চাচীর মারধর ছিল নিত্যদিনের ঘটনা। পান থেকে চুন খসলেই শুরু হত অমানবিক মারধর। প্রায় দিনই না খেয়ে শুয়ে পড়তে হত তাকে। এভাবেই চলছিল। কিন্তু একদিন সাহস করেই বেরিয়ে যান ঘর থেকে।
কিন্তু বিধিবাম। পরিচয় হয় এক লোকের সাথে। নিজের পরিচয় দেয় ‘মামু’ বলে। তার (মামু) বাসায় কয়েকদিন রাখার পর আত্মীয়ের বাসায় বেড়াতে নিয়ে যাওয়ার কথা বলে বিক্রি করে দিয়ে আসে ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের এক যৌন পল্লীতে। সেখানে কয়েক দিন থাকার পর আয়শা বুঝতে পারে, এখান থেকে বের হওয়ার আর কোন রাস্তা নেই। সারাক্ষণ তাকে পাহারা দিয়ে রাখে বেশ কয়েক জোড়া শকুনের চোখ। সেখানে প্রায় ৫ বছর থাকার পর একদিন পুলিশ এসে ভেঙ্গে দেয় আস্তানাটি। এরপর আবার রাস্তায় নেমে আসে আয়শার মত আরো কয়েক শত নারী।
পরে কয়েকজন দালালের মাধ্যমে বিভিন্ন হোটেলে শুরু করে যৌন কাজ। এভাবে ২৭ বছর বয়স পর্যন্ত চলার পর স্থানীয় এক এনজিওর সহযোগিতায় এখন কাজ করছেন এক এইচআইভি ও এইডস সেবাকেন্দ্রে। এই কেন্দ্রে তার কাজ হচ্ছে নারী যৌন কর্মীদের এইচআইভি এবং এইডস সম্পর্কে সচেতন করে গড়ে তোলা।
সরকারী হিসেব অনুযায়ী, দেশে প্রথম এইডস রোগী শনাক্ত হয় ১৯৮৯ সালে। আর এ পর্যন্ত ৬,৪৫৫ জন এইচআইভি সংক্রমিত ব্যক্তি শনাক্ত হয়েছেন। এ পর্যন্ত মারা গেছেন ১,০২২ জন। দেশে এইচআইভি সংক্রমিত মানুষের অনুমিত সংখ্যা ১৩ হাজার। তাদের সবাইকে শনাক্ত করা সম্ভব হয়নি। গত বছরের আগস্ট মাস পর্যন্ত ৩,২৬৫ জনকে সরকার বিনা মূল্যে অ্যান্টিরেট্রোভাইরাল থেরাপি (এআরটি) দিয়েছে।
মূলত নারী যৌনকর্মী, পুরুষ যৌনকর্মী, শিরায় মাদকগ্রহণকারী এবং হিজড়া জনগোষ্ঠী এইচআইভি-এইডসের ঝুঁকিপূর্ণ জনগোষ্ঠী হিসেবে বিবেচিত। সরকারের সাথে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে কয়েকটি জাতীয় এবং এনজিও সংস্থা বাংলাদেশে এইডস রোগী এবং ঝুঁকিপূর্ণদের নিয়ে কাজ করছে।
২০১৫-২০১৬ সালে পরিচালিত সরকারী এক জরিপে দেখা যায়, দেশে যৌনকর্মীর সংখ্যা ১ লাখ ২ হাজার ২৬০ জন। সুই-সিরিঞ্জের মাধ্যমে মাদক গ্রহণকারীর সংখ্যা ৩৩ হাজার ৬৭ জন। আর এসব যৌন কর্মী এবং মাদক সেবনকারীদের সরকারের পাশাপাশি বেশ কয়েকটি এনজিও সেবা দিচ্ছে।
আয়শা বলেন, যখন এই পেশায় আসি তখন কনডম কী তাও জানতাম না। অনেক পুরুষ ব্যবহার করলেও, কনডম ব্যবহার করতে না চাওয়া পুরুষের সংখ্যাই ছিল বেশি। আমিও অত চাপাচাপি করতাম না। আমি নিজেও বুঝতে পারিনি যে কতটা ঝুঁকির মধ্যে ছিলাম। তবে আমার এইচআইভি-এইডস না হলেও অনেক ধরনের যৌন রোগ দেখা দিয়েছিল। দীর্ঘদিন চিকিৎসার পর এখন আমি সুস্থ।
তিনি বলেন, এখন আমি অন্য নারী যৌন কর্মীদের সচেতন করতে কাজ করে যাচ্ছি। তারা যেন যৌন কাজ করার সময় কনডম ব্যবহার করতে বাধ্য করে পুরুষদের। তবে বর্তমানে কনডম ব্যবহারের বিষয়ে অনেক পুরুষ সচেতন হয়েছে বলে তিনি মনে করেন।
আয়শার মতে সরকারের পাশাপাশি যেসব বেসরকারী উন্নয়নমূলক সংগঠন রয়েছে তাদের আরো বেশি এগিয়ে আসতে হবে। তার মতে যার যার নিজের অবস্থান থেকে আমরা এই বিষয়ে সচেতন হই, তবে এইচআইভি-এইডসসহ বিভিন্ন যৌন রোগ কমে আসবে অনেকাংশে।
আয়শার সাথে কাজ করেন রাহেলা খাতুন। পেশায় তিনি যৌন কর্মী না হলেও তিনি বুঝেন যৌন কর্মীদের দু:খ-কষ্ট। তিনি বলেন, প্রায় সব যৌন কর্মীই বিভিন্ন ধরনের যৌন রোগে ভুগছেন। আর এসব রোগের জন্য কনডম ব্যবহার না করাই হচ্ছে অন্যতম মূল কারন। তবে এখন কনডম ব্যবহারের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। আবার অনেক পুরুষ কনডম ব্যবহার করতে চান না।
এদিকে নগরীর বাসাবো বালুর মাঠ সংলগ্ন প্রয়াস নামের এক মাদকসেবনকারীদের সেবাদানকারী এক প্রতিষ্ঠানে দিয়ে দেখা যায়, সেখানে মাদকগ্রহণকারী কয়েক জন সেবা নিচ্ছেন। তার মধ্যে এইচআইভি পজিটিভ মতিন (ছদ্ম নাম) নামের এক যুবক জানান, ২১ বছর বয়স থেকে সে মাদক নিচ্ছে। প্রথমে গাঁজা আর ফেন্সিডিল গ্রহণ করলেও পরে বন্ধুদের পাল্লায় পড়ে শিরায় মাদক নেওয়া শুরু করে। তিনি বলেন, এমন দিন গেছে একই সিরিঞ্জ দিয়ে কয়েক বন্ধু দিনের পর দিন মাদক নিয়েছি। আর এখন আমি এইচআইভি আক্রান্ত। রকন্দ্রে সেবা প্রদানকারী আমিন বলেন, বর্তমানে শিরায় মাদক নেয়ার সংখ্যা দিন দিন বেড়ে চলেছে। এক্ষেত্রে নারীর সংখ্যাও কম নয় বলে তিনি এই প্রতিবেককে জানান। তিনি বলেন, আমাদের প্রতিষ্ঠানে বর্তমানে ৪০ জন মাদক সেবনকারী সেবা নিচ্ছে। তারমধ্যে ১৭ জন নারী। আবার এই সতের জনের মধ্যে নয়জনই হচ্ছে শিরায় মাদক গ্রহণকারী।
তার মতে সরকারকে এ বিষয়ে আরো বেশি কঠোর হতে হবে। পাশাপাশি অন্যান্য বেসরকারী উন্নয়ন সংস্থাগুলোকে আরো বেশি সহযোগীতার হাত বাড়িয়ে দেওয়ার আহ্বান জানান মাদকসেবনকারীদের এই সেবা প্রদানকারী।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/ফই/আসচৌ/১৭৪০/আহো-এসএইচ