বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১ : স্যানিটারি প্যাড বানিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে গাইবান্ধার সুবিধা বঞ্চিত কিশোরীরা

190

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-১
স্যানিটারি-সাবলম্বী
স্যানিটারি প্যাড বানিয়ে স্বাবলম্বী হচ্ছে গাইবান্ধার সুবিধা বঞ্চিত কিশোরীরা
ঢাকা, ৪ জুন, ২০১৯ (বাসস) : এগিয়ে চলছে দেশ, কমছে দারিদ্র্য, বাড়ছে সচেতনতা, স্বাবলম্বী হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের জনগণ। অঞ্চলভেদে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে ওঠায় স্বাবলম্বী হচ্ছে দরিদ্র কিশোরীরা। ফারিয়া, সোমা, শিউলি, যশোদা, মনোয়ারাসহ বারজন কিশোরী মেয়ে এক সাথে গোল হয়ে বসে স্যানিটারি প্যাড বানাচ্ছে। মাঝারি টাইপের আধপাকা এক রুমে সবাই সাদা এপ্রোন পড়ে কাজ করে চলেছে সবাই। আর তাদের বানানো প্যাড চলে যাচ্ছে গাইবান্ধা শহরসহ বিভিন্ন উপজেলায়। প্যাড বিক্রির টাকা থেকে একটি নির্দিষ্ট অংশ হাতে আসে তাদের। আর এসব অর্থ দিয়ে কেউ নিজের পড়ালেখার খরচ চালায়। আবার কেউ তুলে দেয় বাবা-মার হাতে সংসার চালানোর জন্য।
মূলত সুবিধাবঞ্চিত কিশোরীদের দিয়ে এই স্যানিটারি প্যাড তৈরি ও বাজারজাতকরণের বিষয়টি শুরু হয় প্র্যাকটিক্যাল এ্যাকশন বাংলাদেশ নামের একটি বেসরকারি সংস্থার হাত ধরে। শুরুতে পাঁচ কিশোরী নিয়ে চালু হয় স্যানিটারি প্যাড তৈরির কাজ। সে সময় তারা তুলা ছাড়ানো আর সুতা তৈরির মেশিনসহ অন্যান্য সরঞ্জামাদি দিয়ে কাজ শুরু করে। প্রথমে ওই পাঁচ কিশোরীকে প্রশিক্ষণ দেয়া হয় স্থানীয় প্র্যাকটিক্যাল এ্যাকশনের অফিসে। একমাস প্রশিক্ষণের পর শহরের এক প্রান্তে এই রুমটি ভাড়া নিয়ে চলে তাদের প্যাড বানানোর কাজ।
পরে এলাকার নারী উদ্যোক্তা শাহেদা আগ্রহী হয়ে পুরো কারখানার দায়িত্ব নেন। কিশোরীদের লাভের অংশ এবং কাঁচামাল সরবরাহসহ সব দায়িত্ব নিজের কাঁধে তুলে নেন তিনি। নিয়োগ দেন এক বিক্রেতাকে। যার কাজ হলো বিভিন্ন দোকানে বিশেষ করে শহরের ফার্মেসীগুলোতে গিয়ে এসব বিক্রি করা। শুরুর দিকে কিছুটা লোকসান হলেও এখন মাসে সব খরচ বাদ দিয়েও প্রায় ২০,০০০ থেকে ৩০,০০০ টাকা লাভ থাকে বলে জানান শাহেদা।
তিনি বলেন, এই কারাখানায় যেসব কিশোরী মেয়ে কাজ করে তাদের সবাই সমাজের সুবিধাবঞ্চিত। এখানে এ পর্যন্ত প্রায় ১৫০ জনের বেশি কিশোরী মেয়ে বিভিন্ন সময়ে কাজ করেছে। এখানে কাজ করার একটাই সুবিধা যে, দিনের যেকোন সময় এখানে কাজ করা যায়। যে যতটি প্যাড তৈরি করে, সে সেই অনুযায়ী টাকা পায়।
শাহেদা বলেন, এখানে কাজ করে অনেক মেয়েই নিজের লেখাপড়ার খরচ চালাচ্ছে। আবার অনেক মেয়ের সংসার চলেছে এখান থেকে অর্জিত টাকা দিয়ে।
তিনি বলেন, ‘শুরুতে আমার কিছুটা লোকসান হয়েছে। কারন, তখন এসব স্যানিটারি প্যাড দোকানদাররা নিতে চাইত না। কারণ এমনিতেই এখানকার অধিকাংশ মেয়ে বা নারীরা প্যাড ব্যবহার করত না। তারা এ বিষয়ে খুব একটা সচেতনও ছিল না। আবার যারাও ব্যবহার করত তারা স্থানীয়ভাবে তৈরিকৃত এসব প্যাড ব্যবহার করতে চাইত না। অনেক সময় কোন টাকা ছাড়াই প্যাড ব্যবহার করতে দিতাম, যাতে করে তারা বুঝতে পারে আমাদের প্যাডের মান বাজারের অনেক নামী-দামী ব্র্যান্ডের চেয়ে কোন অংশে কম নয়।’
আর এভাবেই এখন আমার কারখানায় তৈরিকৃত প্যাড শুধু গাইবান্ধার শহরে নয় এই জেলার বিভিন্ন উপজেলায়ও বিক্রি হয়।
কারখানায় কর্মরত সোমা দে বলেন, ‘আমরা সবস ময় চেষ্টা করি সেরা মানের প্যাড তৈরি করতে। কারণ আমরা জানি মাসিকের সময় খুব পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন থাকতে হয়। আর নির্দিষ্ট সময় পর প্যাড পাল্টাতে হয়। তাই আমাদের সর্বোচ্চ চেষ্টা থাকে একটি ভালো মানের প্যাড যাতে এখানকার মেয়েরা পায়।’
তিনি বলেন, এখান থেকে প্রতি মাসে পাঁচ হাজার টাকা আসে। এই টাকা থেকে তিন হাজার টাকা মায়ের হাতে দিই। আর দুই হাজার টাকার থেকে আমার প্রাইভেট মাস্টারের বেতন দিই ১৫০০ টাকা। আর বাকি ৫০০ টাকা আমার কলেজে যাওয়া-আসা ভাড়া বাবদ রেখে দিই।
সোমা বলেন, এখানে আমি ক্লাস নাইন থেকে কাজ করছি। এভাবেই আমি এসএসসি পাশ করেছি। আমার পরিবারও খুব খুশি। এছাড়াও আমার আর আমার পরিবারের ব্যবহারের জন্য প্যাড এখান থেকে বিনামূল্যে পাই।
আরেক কিশোরী সুমাইয়া বলেন, বাবা মারা গেছে সড়ক দুর্ঘটনায়। এরপর থেকে মা আর পাঁচ ভাই-বোন একেবারে পথে বসে যাই। আমি তখন মাত্র ক্লাস এইটে পড়ি। আমার পড়া বন্ধ হয়ে যায়। প্রায় এক বছর পর আমার এক বান্ধবী শাহেদা আপার সাথে যোগাযোগ করিয়ে দেয়। তারপর থেকে আজ তিন বছর হল আমি এখানে কাজ করছি। এখন আমি আবার পড়ালেখা শুরু করেছি। আগামী বছর এসএসসি দেব।
শাহেদা জানান, কিশোরীদের বানানো প্যাডগুলো ব্যবহার নিরাপদ বলেই বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকেরা মতামত দিয়েছেন বিভিন্ন সময়।
বাসস ইউনিসেফ ফিচার/ফই/স্বব/১৭২৫/আহো/-এসএইচ