বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : সচেতনতায় শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৬৩ শতাংশ

291

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
সচেতনতায় শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৬৩ শতাংশ
ঢাকা, ৩ জুন, ২০১৯ (বাসস) : বাংলাদেশ বিগত বিশ বছরে শিশু মৃত্যুর হার ৬৩ শতাংশ কমিয়ে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি অর্জন করেছে। ২০০০ সাল থেকে পৃথিবীর প্রায় প্রতিটি দেশ শিশু মৃত্যু হ্রাসে যথেষ্ট উন্নতি করেছে যার মধ্যে দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ অন্যতম।
বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ‘সেভ দ্য চিলড্রেন’ ‘বার্ষিক গ্লোবাল চাইল্ড হুড রিপোর্ট ২০১৯’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়। রিপোর্টের বিশ্লেষণে দেখা যায় যে, দক্ষিণ এশিয়ায় বাংলাদেশ, ভুটান, ভারত ও নেপালে গত দুই দশকে শিশু মৃত্যুর সংখ্যা অনেক হ্রাস পেয়েছে। চারটি দেশের মধ্যে বাংলাদেশ সবচেয়ে বেশি অগ্রগতি অর্জন করেছে, যেখানে ভুটানের শিশু মৃত্যুর হার কমেছে ৬০ শতাংশ, নেপালে ৫৯ শতাংশ এবং ভারতের ৫৭ শতাংশ।
জাতিসংঘের হিসাব অনুযায়ী ডব্লিউএইচও গ্লোবাল হেলথ অবজারভেটরির মতে, এ কার্যক্রমে উন্নয়ন হলেও বাংলাদেশে এখনো নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে প্রতি ঘন্টায় দ’ুটি শিশুর মৃত্যু ঘটে। ২০১৬ সালে পাঁচবছরের নিচে মোট ১৬ শতাংশ শিশুর এবং ১২ থেকে ৫৯ মাস বয়সী শিশুর মধ্যে মোট ৩০ শতাংশ শিশুর মৃত্যুর জন্য নিউমোনিয়া দায়ী।
সংস্থার ডেপুটি কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. ইশতিয়াক মান্নান বলেন,অস্বাস্থ্য ও অপুষ্টি থেকে শুরু করে শিক্ষার অভাব,শিশুমৃত্যু ইত্যাদি নিয়ন্ত্রণের মধ্য দিয়ে শিশুর বিকাশে বাংলাদেশের বিশাল অগ্রগতিকে অবশ্যই মূল্যায়ন করতে হবে। ২০ বছর আগের তুলনায় বর্তমানে বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া শিশুদের স্বাস্থ্যবান, সুখি, শিক্ষিত এবং সুরক্ষিত বেড়ে ওঠার সুযোগ অনেক বেশি।কিন্তু বিশেষ করে দূরবর্তী গ্রামগুলো এবং ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থানে থাকা শিশুদের মধ্যেনিউমোনিয়া মোকাবেলার চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে।বাংলাদেশ নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য মারাত্মক শৈশব রোগের বিরুদ্ধে সফলভাবে কাজ করে যাচ্ছে। এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় কাজের পরিধি আরও বাড়াতে হবে।
আন্তর্জাতিক শিশু দিবস উপলক্ষে ১ জুন ‘গ্লোবাল চাইল্ডহুড রিপোর্ট’ এ ‘এন্ড অফ চাইল্ডহুড ইনডেক্স’ রাখা হয়েছে। যা থেকে দেখা যায়, ২০০০ সাল থেকে ১৭৬টি দেশে শিশুদের সার্বিক পরিস্থিতির উন্নয়ন ঘটেছে। বর্তমান বিশ্বে বছরে ৪.৪ মিলিয়নের কম শিশু মৃত্যু ঘটছে। ৪৯ মিলিয়নের কম খর্বাকায় শিশু জন্মাচ্ছে। ১৩০ মিলিয়নের বেশি শিশু স্কুলে যাচ্ছে। ৯৪ মিলিয়নের কম শিশুশ্রমিক হচ্ছে। ১১ মিলিয়নের কম মেয়েদের জোরপূর্বক বাল্যবিয়ে হচ্ছে। প্রতিবছর ৩ মিলিয়নের কম মেয়ে বয়ো:সন্ধিতে মা হচ্ছে। প্রতিবছর ১২ হাজারের কম শিশু হত্যার শিকার হচ্ছে।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ২৮ মে নিরাপদ মাতৃত্ব দিবস উপলক্ষে তার দেয়া এক বাণীতে বলেছেন,‘আমাদের সামনে বড় চ্যালেঞ্জ ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা(এসডিজি)অর্জনের মাধ্যমে মাতৃমৃত্যুর হার প্রতি লক্ষ জীবিত জন্মে ৭০ এর নীচে এবং নবজাতকের মৃত্যুর হার প্রতি হাজার জীবিত জন্মে ১২ তে নামিয়ে আনা।’
তিনি আরো বলেন,‘এই চ্যালেঞ্জকে সামনে রেখে জাতীয় ৭ম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও রূপকল্প ২০২১ এর আলোকে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রণালয় চতুর্থ স্বাস্থ্য সেক্টর কর্মসূচি (২০১৭Ñ২০২২) বাস্তবায়ন করতে যাচ্ছে।এতে মাতৃস্বাস্থ্য ও নবজাতকের স্বাস্থ্যের উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে।সর্বোচ্চ গুণগত মান বজায় রেখে সেবার পরিধি বৃদ্ধির লক্ষ্যে নতুন হাসপাতাল নির্মাণ,শয্যা সংখ্যা বৃদ্ধি,চিকিৎসক,নার্স,মিডওয়াইফ ও অন্যান্য জনবল নিয়োগ দেয়া হয়েছে।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মা ও শিশু স্বাস্থ্যের উন্নয়ন দেশ ও জাতীয় উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ এ কথা উল্লেখ করে তার দেয়া বাণীতে বলেন,‘বর্তমান সরকার বিষয়টিকে গুরুত্ব দিয়ে প্রসবপর্ব,প্রসবকালীণ,প্রসবপরবর্তী এবং নবজাতকের পরিচর্যার উন্নয়নে জরুরি প্রসূতি সেবা কর্মসূচি ও নিরাপদ প্রসব নিশ্চিত করার লক্ষ্যে ৩ বৎসর মেয়াদি ‘মিডওয়াইফারি’কোর্স চালু করেছে। নবজাতকের জন্য ‘জাতীয় নবজাতক কর্মসূচি চালু হচ্ছে।’
রাজধানীর মাতুয়াইলে শিশু মাতৃস্বাস্থ্য ইন্সিটিটিউট এর পেডিয়াট্রিকস বিভাগের বিভাগীয় প্রধান প্রফেসর ওয়াহিদা খানম জানান,এসডিজি অর্জনের অন্যতম কথাই হলো নবজাতকের স্বাস্থ্য সেবা নিশ্চিত করা।এজন্য বিভিন্ন ধরনের সেবা কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আগে নবজাতককে নিয়ে কিভাবে কার কাছে গেলে সঠিক সেবা পাওয়া যাবে তা জানা সহজ ছিল না। বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার যুগান্তকারী পদক্ষেপে কমিউনিটি ক্লিনিক। বিশ্ব দরবারে এই কার্যক্রম প্রশংসনীয় হয়েছে। তিনি পুরস্কারও পেয়েছেন। সরকারের শুরু থেকেই স্বাস্থ্য ক্ষেত্রে কমিউনিটি ক্লিনিক সেবা চালু হয়েছে। দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষেরাও এর সেবা পাচ্ছে। প্রতি ৬ হাজারে একটি কমিউনিটি ক্লিনিক।এসব ক্লিনিকের স্বাস্থসেবিকা ও সংশ্লিষ্টদের যথাযথ সেবা দিচ্ছে।
তিনি বলেন, শিশু স্বাস্থ্যের জন্য বিশেষজ্ঞ তৈরি হচ্ছে। এছাড়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, ইউনিয়ন সাব সেন্টার,স্যাটেলাইট ক্লিনিক থেকে শুরু করে স্বাস্থ্য পর্যায়ে উন্নয়ন হচ্ছে। এসব স্থানে নবজাতক নিয়ে মায়েরা আসলে তাদের বুকের ব্রেস্ট ফিডিং,স্বাস্থ্য নিয়ে কথা,ওজন পরীক্ষাসহ নানা বিষয়ে পরামর্শ ও সেবা দেওয়া হয়ে থাকে।এছাড়া ক্যাঙারু মাদার কেয়ার সার্ভিসও রয়েছে।অথ্যাৎ মায়ের বুকে শিশু। এ পদ্ধতি খুবই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। এছাড়া উপজেলা পর্যায়ে শিশু বিশেষজ্ঞরা সেবা দিচ্ছেন। তাতে করে যারা সেবা নিতে যাচ্ছেন তারা নি:সঙ্কোচে এবং নিশ্চিন্তে সেবা নিতে পারছেন।যা সমাজে ইতিবাচক প্রভাব রাখছে।
বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, সরকারের সদিচ্ছা ও বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাসহ বিভিন্ন সংগঠনের নানা কার্যক্রমে বাংলাদেশে শিশু মৃত্যুর হার কমছে।এই ধারা অব্যাহত রাখতে সমন্বিত উদ্যোগ প্রয়োজন। জরুরি প্রসূতিসেবা কার্যক্রমসহ মা ও শিশুস্বাস্থের উন্নয়নে স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মীদের ৬ মাস ব্যাপী সিএসবি প্রশিক্ষণ,মাতৃস্বাস্থ্য ভাউচার স্কিম ও ৩ বছর মেয়াদি মিডওয়াইফারি কোর্স চালু করা হয়েছে।সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচির আওতায় দরিদ্র মায়েদের বিশেষ ভাতা দেয়া চালু রয়েছে। তবে,সরকারের পাশাপাশি পরিবারের অভিভাবকদের সচেতনতা,বিশেষজ্ঞ ধাত্রী দিয়ে প্রসব করানো,চিকিৎসকের পরামর্শ ও চিকিৎসা পদ্ধতি মেনে চলার পাশাপাশি জনসচেতনা বাড়লে শিশুমৃত্যুর হার হ্রাস পাবে বলে তারা জানান।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/এসএস/কেজিএ/আহো/১৮০০/এসএইচ