বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৪ : কিশোরীর স্বাস্থ্য রক্ষায় মাসিক নিয়ে আর নয় অজ্ঞতা

176

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-৪
কিশোরীর স্বাস্থ্য রক্ষায় মাসিক নিয়ে আর নয় অজ্ঞতা
॥ ‘সেলিনা শিউলী ॥
ঢাকা, ২৯ মে, ২০১৯ (বাসস) : রাজধানীর বেসরকারি একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী প্রিয়াংকা (ছদ্মনাম) আধুনিক চিন্তাধারার হলেও মাসিক নিয়ে রয়েছে কুসংস্কার। তিনি মাসের বিশেষ কয়েকটা দিন খুব দরকার না হলে বাইরে বের হন না। বাথরুমে দড়ি টানিয়ে তাতে মাসিকের সময় ব্যবহার করা নরম কাপড় শুকাতে দেন। ভীতির কারণে স্যানেটারি প্যাড ব্যবহার করেন না।
প্রিয়াংকা বলেন,‘দাদী বলেছে মাসিকের সময় দৌড় ঝাপ করা যাবে না, কাউকে জানানো যাবে না। যতটা সম্ভব গোপনভাবে লোক চক্ষুর আড়ালে ব্যবহৃত কাপড়ের টুকরো ধুয়ে শুকাতে হবে। তার ধারণা, স্যানেটারী ন্যাপকিন ব্যবহার করলে ক্যান্সারসহ বিভিন্ন ধরণের মেয়েলি অসুখ হতে পারে। তাই ব্যবহারে রয়েছে অনীহা।
মাসিক নিয়ে অজ্ঞতা শুধু প্রিয়াঙ্কারই নয়, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুসের মাঝে এটি নিয়ে রয়েছে নানা অজ্ঞতা এবং কুসংস্কার। অথচ নারীর স্বাস্থ্য সুরক্ষায় মাসিক নিয়ে লুকোছাপা নয়, খোলামেলা আলোচনা করতে হবে। সচেতনতা বাড়াতে হবে। সমাজ যত এগিয়ে যাচ্ছে ততোটাই মাসিকের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি উপেক্ষিত রয়ে যাচ্ছে। কেন না মাসিক নিয়ে অব্যবস্থাপনার কারণে নারীর প্রজনন ক্ষমতা অনেক ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে এমনটাই মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
ওয়ার্ল্ড ভিশন এর প্রোগ্রাম কর্মসূচি উন্নয়ন পরিচালক চন্দন জেড গোমেজ বলেন,আগের দিনে আমাদের সমাজে ‘মাসিক’ নিয়ে যে কুসংস্কার ছিলো তা থেকে এখনো মানুষ পুরোপুরি বের হতে পারেনি। মেয়েদের মাসিক হওয়াটাকে ভয়ের চোখে দেখা এবং গোপন করে রাখা হতো। আসলে এটা যে ভয়ের কিছু নয় প্রাকৃতিক ব্যাপার, নারীত্বের সক্ষমতার এবং মা হওয়ার যোগ্যতা এ বিষয়টিকে পরিষ্কার করে বলা হতো না। পরিবার থেকে মা-দাদীরা মেয়েদেরকে ‘গুপ্ত’ বিষয় বলে এটাকে মেনে নিতে পরামর্শ দিত।
এখনকার সময়েও মাঠপর্যায়ে কাজ করতে গিয়ে দেখেছি মেয়েদের মাসিক নিয়ে পরিবারে বা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তেমন আলোচনা হয়না। পাঠ্য বইয়ে অন্তর্ভূক্ত এ বিষয় নিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বলা হয়,‘ বাসায় পড়ে নিও।’
তিনি বলেন, আমাদের মেয়েরা প্রজনন স্বাস্থ্য সম্পর্কে সঠিকভাবে জানে না। সমাজ, পরিবার ও প্রতিষ্ঠানের তাদের এগিয়ে যাওয়ার পথে বাঁধা তৈরি করছে এভাবে। তবে দৃষ্টিভঙ্গীর পরিবর্তন হচ্ছে।
তিনি বলেন,প্রায় ত্রিশ বছর আগে হলিক্রস স্কুল এন্ড কলেজে মেয়েদের জন্য আলাদা কক্ষ ছিল। যেখানে কিশোরী বয়সের মেয়েদের মাসিকসহ শারীরিক ও মনস্তাত্তিক বিষয়সহ নানা সংকট নিয়ে কাউন্সিলিং করা হতো। বর্তমান সময়ে এটা অত্যন্ত জরুরী। মাসিক ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে সঠিকভাবে না জানলে একজন কিশোরী সঠিকভাবে গড়ে উঠবে না। পরিপূর্ণভাবে জাতি গঠনে এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়।
জাতীয় ক্যান্সার গবেষণা ইন্সটিটিউট ও হাসপাতালের গাইনী অনকোলজির সহকারী অধ্যাপক ডাঃ আফরোজা খানম বলেন, মাসিক নিয়ে আমাদের সমাজে স্টিগমা রয়েছে। এটা নরমাল ফেনোমেনো। অনেকে মাসিক কে মনে করে এটা বাজে ব্যাপার। মাসিক চলাকালীন মেয়েদের বাইরে বের হতে না দেয়া, স্কুলে যেতে বাঁধা দেয়া, মাছ, মাংস, ডিম সহ পুষ্টিকর খাবার খেতে নিরুৎসাহিত করা হয়। পরিবার থেকে বোঝ তে হবে এটা একজন নারীর জীবনে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। কিশোরী বয়সে মাসিক শুরু হবে আবার জীবনের মধ্যম বয়সে মেনোপজের মধ্য দিয়ে শেষ হবে। মাসিক কালীন সময়ে অপরিচ্ছন্নতায় থাকলে ফাঙ্গাল ইনফেকশন হয়। এতে মেয়েরা নানা মেয়েলী অসুখে ভুগতে পারে। পরিস্কার পরিচ্ছন্নতার পাশাপাশি পুষ্টিকর খাদ্য দিতে হবে। যাতে তারা সুস্থ্যভাবে বেড়ে উঠতে পারে। সরকারীভাবে এ বিষয়ে নানা উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। মেয়েরা সচেতন হচ্ছে,যার ইতিবাচক প্রভাব পড়ছে সমাজে।
সেভ দি চিলড্রেনের ম্যানেজার (কমিউনিকেশন এন্ড নলেজ) ফাইজুল করিম বলেন, আমরা মূলত এইচআইভি নিয়ে কাজ শুরু করি। এর একটা বড় অংশ যৌনকর্মী। বিশেষ করে তাদের মাসিক সম্পর্কে অবহিত করার পাশাপাশি অ্যানিমেশন ভিডিওয়ের মাধ্যমে এ সময়ে করণীয় কি তা সম্পর্কে সচেতন করে থাকি। সেভ দি চিলড্রেন-ইউনিসেফের ফান্ডে দেশের প্রায় সাড়ে ১৮ হাজার যৌনকর্মী নিয়ে কাজ করছে। এদের অনেককে কিশোরী যৌনকর্মী তাদের মাসিক চলাকালীন সময়ের স্বাস্থ্য সচেতনতা নিয়ে অবহিত করা হয়। যাতে তারা শারীরিকভাবে সুস্থ্য থাকতে পারেন।
পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় বিভাগের প্রতিমন্ত্রী স্বপন ভট্টচার্য বিশ্বব্যাপি মাসিক স্বাস্থ্য বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা এবং উন্নত মাসিক ব্যবস্থাপনার সুবিধা নিশ্চিতকরনের লক্ষ্যে ২৮ মে মঙ্গলবার ‘মাসিক স্বাস্থ্য দিবস’ উপলক্ষে আয়োজিত সেমিনারে বলেছেন, ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে আগে মাসিক নিয়ে কোন কথা বলিনি এবং এখানে এসে আমার সবচেয়ে চেয়ে যে উপকার হয়েছে তা হলো মাসিক নিয়ে কথা বলতে যে অসস্থি ছিল তা কেটেছে।
তিনি বলেন, সুবিধা বঞ্চিত ও দরিদ্র জনগোষ্ঠীর অনেকে মাসিক চলাকালীন ময়লা কাপড় ব্যবহার করে যা স্বাস্থ্যের জন্য ঝঁকিপূর্ণ। তাই সুলভ মূল্যে প্যাডের ব্যবস্থা করতে হবে যাতে সকলেই তা ব্যবহার করতে পারে। দেশের মোট জনসংখ্যার ৫০ ভাগ নারী। কাজেই তাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার প্রতি গুরুত্ব সহকারে কাজ করতে হবে। তাদের সুস্বাস্থ্য না থাকলে আমরা উন্নত বিশ্ব হিসেবে নিজেদের প্রতষ্ঠিত করতে পারবো না।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/এসএস/-আসচৌ/১৭৫৫/আহো/-এসএইচ