বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২ : বয়স্ক ভাতা তাদের জীবনে স্বস্তি এনেছে

183

বাসস ইউনিসেফ ফিচার-২
বয়স্ক ভাতা-স্বস্তি
বয়স্ক ভাতা তাদের জীবনে স্বস্তি এনেছে
॥ আফরোজা নাজনীন ॥
ঢাকা, ২৯ মে, ২০১৯ (বাসস) : আনোয়ারা বেগম ভুগছেন ডায়াবেটিস ও হার্টের রোগে। তিন মাস পর পর ওষুধ কেনেন। সে ওষুধই হিসাব করে খান। এত হিসেব নিকেশের একমাত্র কারণ তিনি তিনমাস পরপর বয়স্ক ভাতার ১৫’শ টাকা পান। এ টাকাটা অন্য কোনও খাতে খরচ করেন না।
ছেলে আমির চানই বলেছে, মা তুমি এ টাকা দিয়ে শুধু ওষুধই খাইও। আমির চান সাভারের ষোলমাসির এক ইটভাটায় কাজ করে প্রতিসপ্তাহে পায় ৮’শ টাকা। স্বামী মোস্তাফা মিয়া মারা গেছেন। আনোয়ারার বাড়ি সাভারের ভাকুর্তা ইউনিয়নের টোটালিয়াপাড়া গ্রামে।
এ গ্রামের আরো কয়েকজন নারীর সঙ্গে গত ৩ এপ্রিল এ প্রতিবেদকের কথা হয়। তারা উচ্ছ্বসিত হয়ে জানায়, তিন মাস পর পর ১৫ শত টাকায় তাদের অনেক উপকার হয়-ওষুধ কেনা, পানের খরচ দিয়েও তারা নাতী-নাতনীর ছোটখাট আব্দার মেটাতে পারেন। টোটালিয়া পাড়ার ৬৮ বছর বয়সী খোজ বানু এ টাকায় ওষুধ ছাড়াও পান কেনেন। স্বামী নয়া মিয়া মারা যাওয়ার পর খোজ বানু একটু অভাবেই পড়েন। ছেলে যোগালীর কাজ করে পেরে উঠে না। সংসারেও কত খরচ! খোজ বানু বলেন, এই টাকাটা আমার নিজের। হাতে পেলে, খুব ভাল লাগে।
মালিকা বেগম (৭০) জানান, বয়স্ক ভাতা পাওয়ায় তার পাগল মেয়ে মাঝে মাঝেই মুরগী খাইতে পারে। স্বামী খাদান আলি মারা গেছেন। মালিকা তার মেয়েকে নিয়ে স্বামীর ভিটাতেই থাকেন। ছেলে ইয়াদ আলি ঢাকায় থাকে রিক্সা চালায়। মাঝে মাঝে টাকা দেয়।
প্রয়াত এনায়েত আলির স্ত্রী পরিবানু (৬৭) এ টাকা দিয়ে প্রথমেই চাল কেনেন। তাতে সারা মাস নিশ্চিন্তে থাকা যায়। বয়স্ক ভাতা দেয়ার জন্য পরীবানু বর্তমান সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞতাও জানান।
সরকারের এ বয়স্কভাতা অনেক সংসারেই কিছুটা হলেও স্বস্তি এনেছে। প্রবীণ বা বয়স্কদের অনেক সংসারেই বোঝা মনে করা হয়। যাদের আয় কম, অভাব নিত্যসঙ্গী, মানবিক সদাচরণের ধারণা নেই, তাদের পরিবারে বৃদ্ধদের অবস্থা আরও করুণ।
বাংলাদেশে ক্রমান্বয়ে বয়স্ক মানুষের সংখ্যা যেমন বাড়ছে, তেমনি তাদের জীবন যন্ত্রণার কষ্টগাঁথা প্রচার করছে বিভিন্ন সংবাদ মাধ্যম। দেশে এক কোটি বিশ লাখের বেশি বয়স্ক জনগোষ্ঠী রয়েছে।
সূত্র জানায়, সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অধীনে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ের আওতায় বর্তমানে ‘বয়স্ক ভাতা’ হচ্ছে সবচেয়ে বড় কর্মসূচি। বর্তমানে ৬৫ বছর থেকে বেশি বয়স্ক অসচ্ছল ব্যক্তি মাসিক নগদ ৫’শ টাকা করে ভাতা পাচ্ছেন। বাজেটে ভাতা অপরিবর্তিত রেখে এদের সংখ্যা বর্তমানের চেয়ে বাড়িয়ে ৪০ লাখে উন্নীত করা হয়। পূর্বে ৩৫ লাখ ব্যক্তিকে বছরে ২ হাজার ১’শ কোটি টাকা বয়স্ক ভাতা দেয়া হতো। সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের অধীনে ছোট-বড় মিলিয়ে বর্তমানে ১৪৩টি সামাজিক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হচ্ছে।
বর্তমান আওয়ামী লীগ সরকার প্রথম মেয়াদে অর্থাৎ ১৯৯৬-৯৭ অর্থবছরের বাজেটে সামাজিক নিরাপত্তা কর্মসূচি চালু করে। পরবর্তীকালে সব সরকার জনবান্ধব এ কর্মসূচি অব্যাহত রাখে। ২০১৮ -২০১৯ অর্থ বছরের বাজেটে নতুন করে ১১ লাখ গরিব মানুষকে সামাজিক নিরাপত্তা বলয়ে আনা হয়েছে। ফলে, এ কর্মসূচির আওতায় উপকারভোগীর মোট সংখ্যা এখন ৮৬ লাখ। ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ৭৫ লাখ মানুষকে ভাতা দেয়া হয়।
দেশের বয়োজ্যেষ্ঠ দুঃস্থ ও স্বল্প উপার্জনক্ষম অথবা উপার্জনে অক্ষম বয়স্ক জনগোষ্ঠীর সামাজিক নিরাপত্তা বিধান ও পরিবার ও সমাজে মর্যাদা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭-৯৮ অর্থ বছরে ‘বয়স্কভাতা’ কর্মসূচি প্রবর্তন করা হয়। প্রাথমিকভাবে দেশের সকল ইউনিয়ন পরিষদের প্রতিটি ওয়ার্ডে ৫ জন পুরুষ ও ৫ জন নারীসহ ১০ জন দরিদ্র বয়োজ্যেষ্ঠ ব্যক্তিকে প্রতিমাসে ১০০ টাকা হারে ভাতা প্রদানের আওতায় আনা হয়। পরবর্তীতে দেশের সকল পৌরসভা ও সিটি কর্পোরেশনকে এ কর্মসূচির আওতাভুক্ত করা হয়। ভাতা বৃদ্ধি করা হয়।
বর্তমান সরকারের নির্বাচনী ইশতেহার বাস্তবায়নের অঙ্গিকার হিসেবে ২০২১ সালের মধ্যে বয়স্কভাতাভোগীর সংখ্যা দ্বিগুণ করার কথা বলা হয়। ২০০৯-১০ অর্থ বছরে বয়স্কভাতাভোগীর সংখ্যা ২০ লক্ষ জন থেকে বৃদ্ধি করে ২২ লক্ষ ৫০ হাজার জনে এবং জনপ্রতি মাসিক ভাতার হার ২৫০ টাকা থেকে বৃদ্ধি করে ৩০০ টাকায় উন্নীত করা হয়। ২০১০-১১ অর্থ বছরে বয়স্কভাতাভোগীর সংখ্যা ২ লক্ষ ২৫ হাজার জন বৃদ্ধি করে ২৪ লক্ষ ৭৫ হাজার জনে উন্নীত করা হয়। ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে ৩১ লক্ষ ৫০ হাজার বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৫’শ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়। ২০১৭-১৮ এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২১০০ কোটি টাকা।
২০১৮-১৯ অর্থ বছরে আরো ৪০ লক্ষ বয়স্ক ব্যক্তিকে জনপ্রতি মাসিক ৫০০ টাকা হারে ভাতা প্রদান করা হয়। চলতি অর্থ বছরে এ খাতে বরাদ্দ রয়েছে ২৪০০ কোটি টাকা।
বর্তমানে বয়স্কভাতা কার্যক্রমে অধিকতর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিতকরণ এবং সর্বমহলে গ্রহণযোগ্য করে তোলার জন্য বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো; ২০০৪ সালে প্রণীত বাস্তবায়ন নীতিমালা সংশোধন করে যুগোপযোগীকরণ, অধিক সংখ্যক নারীকে ভাতা কার্যক্রমের আওতায় অন্তর্ভুক্তির লক্ষ্যে নারীর বয়স ৬৫ বছর থেকে কমিয়ে ৬২ বছর নির্ধারণ, উপকারভোগী নির্বাচনে স্থানীয় সংসদ সদস্যসহ অন্যান্য জনপ্রতিনিধিদের সম্পৃক্তকরণ, ডাটাবেইজ প্রণয়নের উদ্যোগ গ্রহণ এবং ১০ টাকার বিনিময়ে সকল ভাতাভোগীর নিজ নামে ব্যাংক হিসাব খুলে ভাতার অর্থ পরিশোধ করা হচ্ছে।
বাসস/ইউনিসেফ ফিচার/আনা/আরজি/১৬০৩/আহো/-এসএইচ