খুলনায় দেড় দশকে কৃষিতে উন্নয়ন তিনগুণ

804

খুলনা, ২৮ এপ্রিল, ২০১৯ (বাসস) : বিগত দেড় দশকে কৃষিতে খুলনায় উন্নয়ন হয়েছে পূর্বের তুলনায় প্রায় তিন গুণেরও বেশী। দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলা হওয়ায় ঘূর্র্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, জলাবদ্ধতা, লবণাক্ততা, সেচের পানির দুষ্প্রাপ্যতাসহ বিভিন্ন সমস্যা কৃষি উন্নয়নের ক্ষেত্রে প্রধান অন্তরায়। গত ২০০৭ সালের নভেম্বর মাসে সিডর ও ২০০৯ সালের মে মাসে প্রলয়ংকরী আইলার ছোবলে উপকূল এলাকায় কৃষি মারাত্মক ক্ষতির শিকার হয়। তার প্রভাব সামগ্রিক কৃষি সেক্টরকে বিপর্যস্ত করে তোলে।
এ জেলায় একটি সিটি কর্পোরেশন ও ৯টি উপজেলার জমির আয়তন ৩ লাখ ৭৫ হাজার ১৮৩ হেক্টর। লোক সংখ্যা ২৩ লাখ ৮৮ হাজার ৯২২ জন এবং মোট আবাদি জমির পরিমাণ ১ লাখ ৫১ হাজার ১৮০ হেক্টর। মাত্র দেড় যুগ আগে এ জেলায় কেবলমাত্র স্থানীয় আমনের আবাদ হতো।
২০১২-১৩ অর্থ বছর পর্যন্ত খাদ্য ঘাটতির জেলা হিসেবে পরিসংখ্যানে তালিকা ভূক্ত ছিল খুলনা। আধুনিক জাতের ধান, গম ও ভূট্টা আবাদের সম্প্রসারণ হলে এবং বোরো, আউশ ও রোপা আমনে উপশী জাতের চাষাবাদ সম্প্রসারিত হওয়ায় ২০১৩-১৪ সাল থেকে খাদ্য চাহিদা পূরণ হতে শুরু করে। বর্তমানে এ জেলায় ঘাটতি মিটিয়ে ২৭ হাজার ৩৬৭ মেট্রিকটন উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন হয়। নদী শাসন, পলি ব্যবস্থাপনা, খাল ও নদী খনন, সুষ্ঠু স্লুইচ ব্যবস্থাপনা, পরিকল্পিত উপায়ে মাছ চাষ, লবণ সহিষ্ণু ফসল চাষ, শস্য বহুমুখী করণের মাধ্যমে বিভিন্ন ফসলের আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির অপর সম্ভাবনা এখনও রয়েছে। এ পরিকল্পনা বাস্তবায়নের মাধ্যমে আবাদ ও উৎপাদন বৃদ্ধির সাথে সাথে বৈচিত্রময় শস্য বিন্যাসের এক ক্ষেত্র ভূমি হয়ে উঠতে পারে খুলনা জেলা।
কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্র জানায়, জেলায় ২০১৬-১৭ অর্থ বছরে বার্ষিক মোট খাদ্য উৎপাদন হয় ৫ লাখ ১ হাজার ১৮৪ মেট্রিক টন। খাদ্য চাহিদা রয়েছে ৪ লাখ ৭৩ হাজার ৮১৭ মেট্রিক টন। গত অর্থ বছরে বার্ষিক চাহিদা মিটিয়ে খাদ্য উদ্বৃত্ত রয়েছে ২৭ হাজার ৩৬৭ মেট্রিক টন। ২০১৭-১৮ মৌসুমে প্রণোদনা কর্মসূচির আওতায় জেলায় মোট হেক্টর প্রতি নেরিকা আউশ চাউল উৎপাদন হয় ২.১৭ মেট্রিক টন। উপশী আউশ হেক্টর প্রতি গড় ফলন হয় ২.৬৩ মেট্রিকটন। রোপা আমন ৯১ হাজার ৮৭০ হেক্টর জমি থেকে মোট চাউল উৎপাদন হয় ২ লাখ ৬৯ হাজার ৩৫ মেট্রিকটন। জেলায় বোনা আমন চাষ হয় ৫ হাজার ২৫ হেক্টর জমিতে। চাল উৎপাদন হয় ৬ হাজার ৩০ মেট্রিকটন।
এ ছাড়া রবী মৌসুমে গম, আলু, মিষ্টি আলু, সরিষা, ভুট্টা, ইক্ষু, মরিচ, পিয়াজ, রসুন, ধনিয়া, মসুর, মুগ, খেসারী, মটর, মাসকলাই, অড়হর, তরমুজসহ শীতকালীন শাক-সব্জির উৎপাদন দেড় দশক আগের তুলনায় প্রায় দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে।
সংশ্লিষ্ট দপ্তর থেকে বলা হয়েছে, খরিপ-১ মৌসুমে মোট ৭৫ ভাগ (৮৫ হাজার হেক্টর) জমি পতিত থাকে। এসব জমিতে স্বল্প মেয়াদী ফসল তিল, মুগ, সূর্যমূখী, কুমড়া জাতীয় সবজি, সফেদা, কদবেল ফসলের আবাদ বৃদ্ধি করা সম্ভব। রবি মৌসুমে ৫৫ হাজার হেক্টর জমি পতিত থাকে। পানি সংরক্ষণের ব্যবস্থা করা গেলে এখানে তরমুজ, বোরো, গম আবাদের ফসল বৃদ্ধি করা যায়। এ ছাড়াও বিভিন্ন মৌসুমে পতিত জমিতে পরিকল্পিত ভাবে ফসলের চাষ করা গেলে খুলনা জেলায় স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে উদ্বৃত্ত ফসল অন্যত্র প্রেরণ করা সম্ভব।
খুলনা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পঙ্কজ কান্তি মজুমদার বাসসকে বলেন, খুলনায় কৃষিতে বিপ্লব ঘটানো যেতে পারে। তার জন্য প্রয়োজন একটু পরিকল্পিতভাবে চাষাবাদ এবং কৃষকের চাহিদা অনুযায়ী সহজ শর্তে উপকরণ বিতরণ করা। খুলনা জেলার সম্ভাবনাময় কৃষিতে পতিত জমি কাজে লাগিয়ে এর অগ্রগতি আরও সামনের দিকে এগিয়ে নেয়া সম্ভব।
তিনি বলেন, উপকুলীয় জেলা খুলনা প্রাকৃতিকভাবে লবণ প্রবণ এলাকা। স্থানীয় মৃত্তিকা বিজ্ঞানীদের গবেষণার সুফল হিসেবে খুলনার জমিতে এখন লবণ সহিষ্ণু বিভিন্ন জাতেন ধান ও ভুট্টার চাষ শুরু হয়েছে। খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধির ফলে আইলা ও সিডর এলাকার কৃষকদের মুখে এখন হাসি ফুটতে শুরু করেছে।
যোগাযোগ করা হলে খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রোটেকনোলজী বিভাগের অধ্যাপক ড. মনিরুল ইসলাম জানান, সম্ভাবনাময় খুলনার কৃষিতে উল্লেখযোগ্য সমস্যা হিসেবে কাজ করছে লবণাক্ততা, অপরিকল্পিত চিংড়ি ঘের, জলাবদ্ধতা, রবি ফসল চাষের সমস্যা, কৃষিপণ্য বাজরজাত করণে সমস্যাসহ বিভিন্ন প্রতিবন্ধকতা। আর এসব সমস্যা দূরিকরণে প্রয়োজন স্লুইস গেটের মাধ্যমে মিঠাপানি সংরক্ষণ এবং খাল ও পুকুর পুন: খননের মাধ্যমে মিঠা পানি ধরে রাখার ব্যবস্থা করা, পরিকল্পিত ভাবে চিংড়ি চাষ এলাকা নির্ধারণ, জলাবদ্ধতা থেকে ফসল রক্ষার জন্য ড্রেন তৈরি, কৃষকদের প্রশিক্ষণ, উৎপাদিত ফসলের বাজার মূল্য নিশ্চিত করাসহ কৃষি গবেষণা ও কৃষি সম্প্রসারণ বার্ষিক কর্মশালার জন্য জেলা বা অঞ্চল ভিত্তিক অর্থিক বরাদ্দের ব্যবস্থা করা।