নাটোরে অসহায়ের আশ্রয়স্থল আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা

311

নাটোর, ২৮ এপ্রিল, ২০১৯ (বাসস) : অসহায় মানুষের আইনী সহায়তা প্রাপ্তির আশ্রয়স্থল হয়ে উঠেছে নাটোরের জজ কোটে স্থাপিত জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার জেলা অফিস। জেলায় কার্যক্রম শুরুর পর থেকে বিগত আড়াই দশকে সরকারি খরচে এক হাজার ৭৩১টি দেওয়ানী, ফৌজদারী ও পারিবারিক মামলার নিষ্পত্তি করে দিয়েছে। বর্তমানে এ সংস্থা তিন হাজার ২৬২টি মামলা পরিচালনা করছে।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার জেলা অফিস সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৪ সাল থেকে ২০১৯ সালের জানুয়ারী মাস পর্যন্ত সময়ে আবেদনকৃত পাঁচ হাজার ৫৪৮টি দরখাস্তের মধ্যে চার হাজার ৯৯৩টি আবেদন আমলে নিয়ে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে এক হাজার ৭৩১টি মামলার নিষ্পত্তি হয়েছে।
২১ জুলাই ২০১৪ প্রকাশিত আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের বাংলাদেশ গেজেটে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে সরকারি খরচে আইনগত সহায়তা প্রাপ্ত ব্যক্তিদের তালিকা উল্লেখ করা হয়েছে। এ তালিকায় রয়েছেন বাৎসরিক এক লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়সীমার অসচ্ছল ব্যক্তি এবং মুক্তিযোদ্ধার ক্ষেত্রে দেড় লক্ষ টাকা পর্যন্ত আয়সীমার মুক্তিযোদ্ধা সহ কোন শিশু, মানব পাচারের শিকার কোন ব্যক্তি, শারীরিক ও মানসিক এবং যৌন নির্যাতনের শিকার নারী ও শিশু, ভবঘুরে, নৃ-গোষ্ঠীর কোন ব্যক্তি পারিবারিক সহিংসতার শিকার বা ঝুঁকিতে থাকা ব্যক্তি, বয়স্ক ভাতা প্রাপ্ত ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী দুস্থ মহিলা, এসিডদগ্ধ নারী বা শিশু, অসচ্ছল বিধবা, স্বামী পরিত্যক্তা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তি, আদর্শ গ্রামে গৃহ বা জমি বরাদ্দ প্রাপ্ত ব্যক্তি এবং বিনা বিচারে আটক ব্যক্তি।
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার জেলা অফিস ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তিদের কাছ থেকে প্রাপ্ত আবেদনগুলো যাচাই-বাছাই করে বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমেও বেশ কয়েকটি অভিযোগের নিষ্পত্তি করা দিয়েছে। বর্তমানে আরো আটটি পারিবারিক বিরোধ উভয় পক্ষের সম্মতিতে আদালতে না পাঠিয়ে বিকল্প বিরোধ নিষ্পতির মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টা চলছে।
জেলার বড়াইগ্রাম উপজেলার দক্ষিণ মালিপাড়া গ্রামের মোছাঃ ফুলবানু আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা নাটোর অফিসের মাধ্যমে বড়াইগ্রাম পারিবারিক আদালতে স্বামী মোঃ শফিকুল ইসলামের বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করেন। ছয় মাসেরও কম সময়ে মামলার একতরফা নিষ্পত্তি হয়েছে। শুরু বিনে পয়সায় নয় দ্রুত মামলার নিষ্পত্তি এ সংস্থার উদ্যোগেই সম্ভব হয়েছে বলে জানান ফুলবানু।
নাটোর সদর উপজেলার আউড়াইল গ্রামের হযরত আলীর উচ্চ শিক্ষিত মেয়ে মুসলিমা খাতুনের সাথে বিয়ে হয়েছিল বিপ্রহালসা গ্রামের আব্দুল কাদের মোল্লার ছেলে আমীর হোসেনের। সংসার আলো করে জন্ম নেয় কন্যা মনিকা। কিন্তু পারিবারিক কলহে ব্যর্থ হয় দাম্পত্য সম্পর্ক। রাগী জেদী আমীর হোসেন তাঁর তিন বছরের কন্যা মনিকাকে রেখে দেন নিজের কাছে। অসহায় মা শিশু কন্যাকে নিজের হেফাজতে নিতে শরনাপন্ন হন আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা অফিসের। গত বছরের ২৪ অক্টোবর আবেদনের একদিনের মাথায় ফিরে পান কন্যাকে। বাবার কাছ থেকে ব্যবস্থা হয় কন্যার খোরপোসের।
একইভাবে সংস্থার মীমাংসা বৈঠকে তালাকের পরে নির্ধারিত ৯০ দিন অতিক্রম করার প্রেক্ষাপটে আবারো বিয়ে রেজিষ্ট্রির মাধ্যমে ২২ বছরের দাম্পত্য সম্পর্ক জোড়া লেগেছে সিংড়া এলাকার কৃষক সেকেন্দার আলী ও গৃহবধূ মাছুরা বিবি মেনেকার। জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থার মাধ্যমে ২২ বছরের সংসার ফিরে পাওয়া গৃহবধূ মাছুরা বিবি মেনেকা বলেন, তালাকের কারণে একমাত্র ছেলের পড়াশোনায় ছন্দপতন এসেছিল, এখন ছেলের পড়াশোনা অব্যাহত থাকবে। লিগ্যাল এইড অফিস আমাকে সচেতনতা দিয়েছে, আমি আমার ভূল বুঝতে পেরেছি, সংসারে শান্তি ফিরে এসেছে-এমনই অভিব্যক্তি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তি কার্যক্রমের বিবাদী আতাউর রহমানের।
সার্বক্ষণিক একজন লিগ্যাল এইড অফিসারের নেতৃত্বে জেলায় একটি পূর্ণাঙ্গ অফিস কাজ করছে। জাতীয় আইনগত সংস্থার নাটোর জেলা কমিটির নিয়মিত মাসিক সভাগুলোতে মামলার অগ্রগতি পর্যালোচনা করে প্রয়োজনীয় দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়। জেলায় পাঁচ জন নারী আইনজীবী সহ মোট ৬০ জন আইনজীবী সংস্থার মামলাগুলো যথাযথভাবে পরিচালনা করছেন।
শুধু আর্থিক অস্বচ্ছল ব্যক্তিই নয় বরং স্বচ্ছল ব্যক্তিরাও এ অফিসের মাধ্যমে তাদের দেওয়ানী ও ফৌজদারী সংক্রান্ত যে কোন বিরোধের নিষ্পত্তি করতে পারেন। আইনী সহায়তা গ্রহণের সক্ষমতা নেই বা সহযোগিতার মানুষ নেই-এমন বন্দী কারাগার কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে কিংবা নির্যাতনের শিকার হয়ে হাসপাতালে ভর্ত্তি কোন নারী বা শিশু ওয়ান ষ্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের মাধ্যমে এই সংস্থা থেকে নিয়মিত আইনী সেবা পেয়ে যাচ্ছেন।
সিনিয়র সহকারী জজ ও জেলা লিগ্যাল এইড অফিসার মোঃ মতিউর রহমান জানান, নিয়মিত মামলার পাশাপাশি বিকল্প বিরোধ নিষ্পত্তির মাধ্যমে অসহায় মানুষের সেবা প্রদানে কাজ করছি আমরা। ভবিষ্যতে এই কার্যক্রমের পরিধি বৃদ্ধির জন্যে আমাদের তৎপরতা অব্যাহত থাকবে।