বাজিস-৬ : ঈদে টাঙ্গাইলে মাকুর শব্দে মুখর তাঁতী গ্রামগুলো

147

বাজিস-৬
ঈদ-টাঙ্গাইল
ঈদে টাঙ্গাইলে মাকুর শব্দে মুখর তাঁতী গ্রামগুলো
॥ ইফতেখার অনুপম ॥
টাঙ্গাইল, ১০ জুন, ২০১৮ (বাসস) : ‘নদী-চর-খাল-বিল গজারির বন, টাঙ্গাইল শাড়ি তার গর্বের ধন’। এটি মূলত টাঙ্গাইল জেলার স্লোগান। ঈদসহ যেন কোন উৎসবেই বাঙালি নারীদের প্রথম পছন্দই হলো শাড়ী। তাই চাহিদা মেটাতে শাড়ী তৈরিতে ঈদের এই সময়ে দিনরাত তাঁতের মাকুর খটখট শব্দ শোনা যাচ্ছে গ্রামগুলোতে। পথে যেতে যেতে দেখা যায় প্রায় বাড়ির উঠোনজুড়েই রোদে রঙিন সুতা শুকানোর দৃশ্য। জীবন-জীবিকার সঙ্গে জড়িত থাকায় এখানে ঘরে ঘরে তৈরি হয় তাঁতের শাড়ি। সারাবছরই এখানে শাড়ির বাজার জমজমাট থাকে। রমজান মাস এলেই তা আরও সরগরম হয়ে ওঠে। ঈদ যতই এগিয়ে আসছে, টাঙ্গাইলের পাইকারি ব্যবসায়ীদের পাশাপাশি খুচরা ক্রেতাদের আনাগোনা ততই বাড়ছে। ঐতিহ্যবাহী টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা এখন দেশর গন্ডি ছাড়িয়ে ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে সমাদৃত।
জানা যায়, টাঙ্গাইল জেলা সদরের করটিয়া, বাজিতপুর, এনায়েতপুর, পোড়াবাড়ী, চাড়াবাড়ী, বেলতা, দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল, চন্ডি, নলশোধা, কালিহাতী উপজেলার বল্লা, রামপুর, রায়পুর, কোকডহড়া, কাজিবাড়ী, খুসিল¬া, মোমিনগর, উত্তর ছাতিহাটি, দক্ষিণ ছাতিহাটি, পশ্চিম ছাতিহাটি, সিঙ্গাইর, দত্তগ্রাম, টেঙ্গগুরা, গোহালিয়াবাড়ী, নাগবাড়ী, বীরবাসিন্দা ও সহদেবপুরের প্রায় সাত হাজারেরও অধিক তাঁতি শাড়ি উৎপাদন করেন। কাপড় ব্যবসায়ীরা এসব গ্রাম থেকেই কম মূল্যে শাড়ি কিনেন। পরে তা পাথরাইল হাট, করটিয়া হাট, বাজিতপুর হাট, বাবুর হাট এবং বঙ্গবন্ধু সেতু পূর্ব স্টেশন সংলগ্ন জুগারচর হাটে পাইকারি মূল্যে বিক্রি করেন।
কোকডহরা গ্রামে গিয়ে দেখা যায়, এখানকার প্রায় ১০০ পরিবার তাঁতের সঙ্গে জড়িত। প্রতিটি বাড়ির লোকজন ঈদ সামনে রেখে শেষ মুহূর্তের বাজারের চাহিদা মেটাতে এখন মহাব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে। শাড়ি বুনেন পুরুষরা, চরকায় সূতা কেটে সহায়তা করেন নারীরা। শাড়ি বোনার তাঁত কয়েক রকমের রয়েছে। তার মধ্যে চিত্তরঞ্জন, পিটলুম, অটোমেটিক, সেমি অটোমেটিক তাঁত উল্লেখযোগ্য। এসব তাঁতে তৈরি হয় নানা রঙ ও ডিজাইনের নানা নামের শাড়ি।
কোকডহরা গ্রামের বাবা সূর্যত আলীর হাত ধরে ২০ বছর আগে তাঁতের বুনন শুরু করেন মোহাম্মদ সাইফুল। তার কথা মতে, শাড়ির নিজের কিছু ইতিহাস আছে। বিশেষ ধরনের বুননের সঙ্গে তাঁতের শাড়ি যারা পড়েন, তাদের শিল্পবোধ ও প্রয়োজনের সম্মিলন জড়িত। এসব অঞ্চলের প্রায় পরিবারের জীবন-জীবিকা চলে তাঁতের শাড়ি বুনে। ভোর থেকে সন্ধ্যা অবধি চলে বুনন কাজ। মাত্র ২০ থেকে ৩০ টাকা লাভেই আড়তদারদের কাছে শাড়ি বিক্রি করেন তারা। সাইফুল ইসলাম জানান, তার তত্ত্বাবধানে ১১ জন কারিগর কাজ করেন। প্রতিদিন একজন কারিগর ছয়টি শাড়ি বোনেন। প্রতি সপ্তাহে দুই হাজার ৫শ’ শাড়ি উৎপাদন হয়। ডিজাইন অনুযায়ী প্রতি পিস শাড়ির মূল্য ৩৩০ থেকে ৪শ’ টাকা।
টাঙ্গাইলের তাঁত শাড়ি বিশেষত অনন্য হয়েছে বিভিন্ন নকশা ও ডিজাইনের জন্য। এছাড়াও প্রতি বছর নতুন নতুন কারুকার্যের কারণে দেশ ও বিদেশে এর চাহিদাও রয়েছে প্রচুর। শাড়ির পাশাপাশি এখানে তৈরি হচ্ছে থ্রি পিস, ওড়না ও পাঞ্জাবির কাপড়। সুতার গুণগতমান ও ডিজাইন ভেদে বিভিন্ন দামের শাড়ী তৈরী হয় টাঙ্গাইলে। তাই দূরদূরান্ত থেকে আসছে ব্যবসায়ী এবং ক্রেতারা। সর্বনিন্ম ৫শ’ টাকা থেকে সর্বোচ্চ লাখ টাকা দামের তাঁতশাড়ী তৈরি হয় পাথরাইলের তাঁত পল্লীতে। সুতি জামদাতি, হাফসিল্ক, অঙ্কুর কাতান, সূতি পিওর বালুচড়ি, হাসিখুশি কাতান তৈরি হচ্ছে। ঈদকে সামনে রেখে ক্রেতাদের চাহিদার বিষয় বিবেচনা করে ডিজাইনারা শাড়িতে এনেছেন নতুন্ত ও নানা বৈচিত্র।
পাইকারি ব্যবসায়ীর সমাগম ঢাকা থেকে আসা শাড়িঘরের মালিক মনতাজ উদ্দীন বলেন, রোজার শুরুতে এসে যে চালান নিয়ে যাই, তা শেষ হয়ে গেছে। মাঝে ফোনে চাহিদা জানিয়ে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে শাড়ি নিয়েছি। কিন্তু এবার টাঙ্গাইল শাড়ির চাহিদা বেশি। তাই শেষ মুহূর্তে নতুন ধরনের শাড়ি নিতে নিজেই চলে এসেছি।
বল্ল¬া বাজারের বেশ কয়েকজন তাঁতি জানান, তাদের কারও এখন দম ফেলার সময় নেই। ব্যবসায়ীদের চাহিদা অনুয়ায়ী এখন অতিরিক্ত সময় ধরেও বুনন করতে হচ্ছে। দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে ব্যবসায়ীরা ফোনেও চাহিদা জানাচ্ছেন। সে অনুযায়ী কুরিয়ার সার্ভিসে শাড়ি পাঠানো হচ্ছে। বাজারের ফারুক ট্রেডার্সের মালিক ফারুক হোসেন বলেন, রোজার মাস তিনেক আগে থেকেই শুরু হয় ঈদ বাজারের প্রস্তুতি। নতুন নতুন নকশা তৈরি করে শাড়ি বুনন শুরু হয়। শাড়ি কিনতে রোজা শুরুর ১০-১৫ দিন আগে থেকেই পাইকারি ব্যবসায়ীদের আসা শুরু হয়েছে। চলে ঈদের আগের দিন পর্যন্ত। আর খুচরা ক্রেতাদের আসা শুরু হয়েছে ১৫ রোজার পর থেকেই। এখানকার শাড়ি দেখতে যেমন সুন্দর, তেমনি দামেও কম। এটিই এ হাটের বিশেষ আকর্ষণ। এখানে ৩৫০ থেকে ৮শ’ টাকায় ভালো শাড়ি পাওয়া যায়। এছাড়া পাওয়া যায় মোটা সুতার জাকাতের শাড়ি। এ শাড়িগুলো যে বিশেষ ধরনের তাঁতে তৈরি হয়, তার নাম চিত্তরঞ্জন তাঁত। চিত্তরঞ্জন তাঁতকে সেমিঅটোমেটিক তাঁতও বলা হয়। সপ্তাহের প্রতি শনিবার সকাল ৬টা থেকে ১০টা পর্যন্ত চলে বল্ল¬ার এ ঐতিহ্যবাহী হাট।
কালীহাতি উপজেলায় অবস্থিত বল্ল¬া তাঁত বোর্ডের হিসাব অনুযায়ী, তাঁত (হ্যান্ডলুম) সংখ্যা ৪১ হাজার ৭১টি। আর পাওয়ার লুম প্রায় ১০ হাজার। এখানে প্রতি মাসে বস্ত্র উৎপাদন হয় প্রায় ৭২ লাখ গজ। প্রতি মাসে বিক্রি হচ্ছে অন্তত ২৭ কোটি টাকা। সুতা এবং রং আমদানি হচ্ছে প্রায় ২৫ কোটি টাকার। তাঁতের শাড়ি ঘিরে টাঙ্গাইলের তাঁত প্রধান তিন উপজেলায় রঙ এবং সুতার ব্যবসাও জমে উঠেছে বহু বছর ধরে। এখানকার ব্যবসায়ীরা জানান, স্বাধীনতা-উত্তরকাল থেকে বল্লায় তৈরি সাধারণ মানের তাঁতের শাড়ি এখন ‘বিখ্যাত টাঙ্গাইল শাড়ি’ হিসেবে পরিচিত হয়ে উঠেছে। তাঁতশিল্পীদের নিপুণ হাতে বুনন করা এ শাড়িই আজ দক্ষিণ এশিয়ার সীমানা পেরিয়ে ইউরোপ-আমেরিকা জয় করেছে।
সুতার দোকান রয়েছে। তবে এ বাজারে তাঁতিদের কোনো শো-রুম নেই। ব্যবসায়ীরা সরাসরি এখানকার তাঁতিদের কাছ থেকে শাড়ি কিনে নেন। পরে পাথরাইল হয়ে অন্যান্য হাটে ওই শাড়িই পাইকারি দরে বিক্রি করেন। অর্থাৎ টাঙ্গাইলের তাঁতের শাড়ির ৯০ ভাগই উৎপাদন হয় বল্ল¬া, রামপুরসহ আশপাশের গ্রামে।
দেলদুয়ার উপজেলার পাথরাইল শাড়ী ব্যবসায়ী সমিতি সাধারণ সম্পাদক সোহরাব হোসেন বলেন, ঈদে টাঙ্গাইলের শাড়ী সবার ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে রাখা হয়েছে। অস্টেলিয়া, কানাডা, ইংল্যান্ডে শাড়ি রপ্তানি করা হচ্ছে। ঈদের এই সময়ে শাড়ীর চাহিদা আরও বৃদ্ধি পেয়েছে। আধুনিক ডিজিটার যুগের সাথে তাল মিলিয়ে ব্যবসায়ীরা এবার অনলাইনেও শাড়ী ক্রয় ও বিক্রি করছেন।
বাসস/সংবাদদাতা/আহো/১৭০০/মরপা