জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় সম্মিলিতভাবে লড়াই করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

403

ঢাকা, ৮ এপ্রিল, ২০১৯ (বাসস) : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জলবায়ু পরিবর্তনকে পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য ‘নিরাপত্তা হুমকি’ উল্লেখ করে এই হুমকি মোকাবেলায় ঐক্যবদ্ধভাবে কাজ করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।
২৬ মার্চ ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরামের ওয়েবসাইটে প্রকাশিত এক নিবন্ধে তিনি লিখেছেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে কাজ করার এখনই সময়। জলবায়ু পরিবর্তনের ব্যাপারে কারো বিন্দুমাত্রও সন্দেহ থাকলে, তাকে আমি বাংলাদেশে এসে দেখে যাওয়ার আমন্ত্রণ জানাই। আমি তার সাথে হেঁটে হেঁটে জলবায়ু পরিবর্তন কিভাবে নীরবে এখানকার লাখো মানুষের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে তা দেখাতে প্রস্তুত আছি।’
ওয়ার্ল্ড ইকোনোমিক ফোরাম (ডব্লিউইএফ) সুইজারল্যান্ডের কলোগনি-জেনেভা ভিত্তিক একটি অলাভজনক সংস্থা। ১৯৭১ সালে প্রতিষ্ঠিত এ সংস্থার মিশন হলো- ব্যবসায়ী, রাজনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ ও সমাজের অন্য নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বৈশ্বিক, আঞ্চলিক ও শিল্প সংক্রান্ত এজেন্ডা নিয়ে সম্পৃক্ততার মাধ্যমে বিশ্বের অবস্থার উন্নয়ন।
নিচে প্রধানমন্ত্রীর নিবন্ধের অনুবাদ তুলে ধরা হলো-
পর পর তিন বছর বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের বৈশ্বিক ঝুঁকি প্রতিবেদন জলবায়ু পরিবর্তনকে বৈশ্বিক ব্যবসায় ও শিল্পের সবচেয়ে মারাত্মক হুমকি হিসেবে সনাক্ত করেছে। প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে যে, ‘জলবায়ু পরিবর্তন, পানি সংকট, প্রাকৃতিক দুর্যোগ প্রশমন ও অভিযোজনে ব্যর্থতা বিশ্বব্যাপী ব্যবসায় ও শিল্পের ওপর বিরূপ প্রভাব ফেলবে।’
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব বাংলাদেশের মত এত কাছ থেকে আর কোথাও কেউ দেখেনি। আমি জন্মেছি প্রাচীন নদীবাহিত গ্রামবাংলায়। বিগত শতাব্দীর পঞ্চাশ ও ষাটের দশকে আমি যখন গ্রামাঞ্চলে বেড়ে উঠি, তখন আমাদের পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ সরবরাহ ও রাস্তাঘাট ছিল না। নদী ও বর্ষাকালীন বন্যা ছিল আমাদের জীবনেরই অংশ। বাংলাদেশ মানুষের জীবন ও জীবিকা কিভাবে ভূমি, নদ-নদী, জলাশয় ও সমুদ্রের সঙ্গে অঙ্গাঙ্গি জড়িয়ে আছে তা আমার পিতা প্রায়ই বর্ণনা করতেন।
তখনো আমাদের জীবন বর্তমানের মতই আরামদায়ক ছিল। কিন্তু প্রকৃতি তখন এখনকার মত এত চ্যালেঞ্জিং ও অপূর্বাভাসযোগ্য ছিল না। চরম হতাশার বিষয় হলো পরিবেশ ধ্বংসে ভূমিকা না রেখেও আমরা এমন এক পরিস্থিতির সম্মুখীন যেখানে বাংলাদেশ বিশ্বের সবচেয়ে জলবায়ু-অসহায় দেশগুলোর অন্যতম।
বিশ্ব স্বীকার করছে যে, ক্রমবর্ধমান ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও মৌসুমি ও বন্যায় কিভাবে বাংলাদেশের মানুষের জীবিকাকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে। আমাদের দক্ষিণ সীমান্তে বঙ্গোপসাগর ক্রমেই এসিডিক হয়ে উঠছে। সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ার ফলে আমাদের জনসংখ্যার এক-তৃতীয়াংশ বাস্তুচ্যুত হওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাবের ফলে প্রতিবছর আমাদের ২%-৩% জিডিপি হারানোর ঝুঁকি থাকে।

আমাদের কর্মময় বদ্বীপের অভ্যন্তরে প্রতিটি বর্ষা ও বন্যায় নদীর তীর ভেঙ্গে যায়। বহু পরিবার রাতারাতি ভূমিহীন ও অসহায় হয়ে পড়ে। হাজার হাজার একর মূল্যবান ফসলি-কৃষি জমি নদীগর্ভে হারিয়ে যায়। আর তাই এটি আশ্চর্যের বিষয় নয় যে, প্রতিবছর বিশ্বের প্রধান প্রধান নদীগুলো যে পরিমাণ পলি বহন করে তার প্রায় এক-চতুর্থাংশই বহন করে আমাদের নদীগুলো।
অনিয়মিত বৃষ্টি ও বৃষ্টিপাতের প্রাবল্য এবং বর্ধমান উষ্ণতা আমাদের জনগণের জন্য চাষাবাদকে কঠিন করে তোলে। আমি যখন বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে কথা বলি অনেকে শুষ্ক মৌসুমে অনাবৃষ্টি বা খরার প্রসঙ্গ তুলে ধরেন। ফেব্রুয়ারির গোড়ার দিকে যুক্তরাজ্যের আবহাওয়া অফিস পূর্বাভাস দিয়েছে যে, ২০১৪ থেকে ২০২৩ পর্যন্ত দশকটি ১৫০ বছরের মধ্যে সবচেয়ে উষ্ণতম হবে।
পরিবর্তনশীল জলবায়ু নতুন নতুন রোগের জন্ম দিচ্ছে। ম্যালেরিয়ার মতো রোগ- যা আমরা সফলভাবে নির্মূল করেছি- আবারো ফিরে আসার ঝুঁকি সৃষ্টি হয়েছে। শস্য, প্রাণিসম্পদ ও হাঁস-মুরগির রোগের ক্ষেত্রেও একই ধরনের ঝুঁকি প্রতীয়মান। তাপমাত্রার ওঠা-নামা আমাদের মৎস্য শিল্পের জন্যও চ্যালেঞ্জিং। এসব কিছু উন্নয়নের ক্ষেত্রে আমাদের মূল্যবান অর্জন এবং প্রশংসনীয় দারিদ্র্য নির্মূল প্রয়াসকে মারাত্মক ঝুঁকিতে ফেলে দিয়েছে।
এসব চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও বাংলাদেশ আজ বিশ্বে চাল উৎপাদনে চতুর্থ, মাছ উৎপাদনে চতুর্থ, সবজি উৎপাদনে পঞ্চম স্থানে এবং ফল উৎপাদনে শীর্ষ দশের মধ্যে রয়েছে। আমরা বিশ্বকে উপহার দিচ্ছি এক জাদুকরী আঁশ পাট- যা জলবায়ু পরিবর্তন রোধে সহায়তা করে। এছাড়া জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে অভিযোজনে আমাদের নিজস্ব প্রয়াসের অংশ হিসেবে আমরা ধকল সহিষ্ণু ফসলের জাতও উদ্ভাবন করেছি। আর এসব কিছু সম্ভব হয়েছে আমাদের কৃষকদের অব্যাহত মেধা ও উদ্ভাবনী শক্তির কল্যাণে।
কিন্তু আমরা চিন্তিত যে, যে অগ্রগতি আমরা অর্জন করেছি তা হয়ত ধরে রাখতে পারবো না। বাংলাদেশ বিশ্বব্যাপী জলবায়ু পরিবর্তন অভিযোজন প্রচেষ্টার ক্ষেত্রে এক ধরনের অনীহা লক্ষ্য করছে। গত দশকজুড়ে বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ কিভাবে নদীভাঙন, পানি সংকট, লবণাক্ততার অনুপ্রবেশ ও ভূ-গর্ভস্থ পানিতে আর্সেনিক দূষণের কারণে তাদের পিতৃ-পুরুষের ভিটে-বাড়ি থেকে উচ্ছেদ হয়ে যাচ্ছে তা আমি বিশ্ববাসীকে বলে আসছি।