অন্ধকার থেকে আলোর পথে আসার প্রত্যয়ে পাবনায় ৬ শতাধিক চরমপন্থীর আত্মসমর্পণ

448

পাবনা, ৮ এপ্রিল, ২০১৯ (বাসস) : পরিবার আর স্ত্রী-সন্তান থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে দিন-রাত পালিয়ে বেড়ানো, খাওয়া-ঘুম ঠিক নেই, পেছনে পুলিশ আর সামনে প্রতিপক্ষের সন্ত্রাসী। এমন জীবন কেইবা চান। তারপরও সন্ত্রাসী জীবনে জড়িয়ে এমন জীবনই এতদিন কাটিয়েছেন চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানের কারণে কোণঠাসা হয়ে পড়েছে সন্ত্রাসীরা। এই চরমপন্থী সন্ত্রাসীরা এতদিন যারা ছিলেন অন্ধকার জীবনের বাসিন্দা। তারাই সবকিছু ছেড়ে সরকারে আত্মসর্মপণের সুযেগে এবার সুস্থ জীবনে ফেরার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
পাবনাসহ উত্তর ও দক্ষিণবঙ্গের ১৫ জেলার প্রায় ৬ শতাধিক চরমপন্থী মঙ্গলবার (৯ এপ্রিল) পাবনার শহীদ অ্যাডভোকেট আমিনউদ্দিন স্টেডিয়ামে আয়োজিত অনুষ্ঠানে আত্মসমর্পণ করবে বলে জানা গেছে।
এদিন বিকেলে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল ও পুলিশের আইজিপি ড. জাবেদ পাটোয়ারীর কাছে আগ্নেয়াস্ত্র ও দেশীয় অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের মধ্য দিয়ে স্বাভাবিক জীবনে ফিরবেন চরমপন্থী দলের সদস্যরা।
পাবনার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার গৌতম কুমার বিশ্বাস এ তথ্য নিশ্চিত করে বলেন, গত মাসে বিভিন্ন চরমপন্থী দলের ৬১৪ জন সদস্য আত্মসমর্পণের জন্য তাদের নাম তালিকাভুক্ত করেছে। প্রতিদিনই আরও বিভিন্ন দলের সদস্যরা আত্মসমর্পণে আগ্রহী হচ্ছে। আশা করছি আত্মসমর্পণকারীদের সংখ্যা সাতশ’ ছাড়িয়ে যাবে। জেলা পুলিশ জানায়, পাবনা, নাটোর, বগুড়া, নওগাঁ, জয়পুরহাট, রাজশাহী, রংপুর, কুষ্টিয়া, নড়াইল, রাজবাড়ী, যশোর, খুলনা, সাতক্ষীরা, টাঙ্গাইল, ফরিদপুর জেলায় সক্রিয় বিভিন্ন চরমপন্থী দলের সদস্যরা স্বাভাবিক জীবনে ফিরতে আত্মসমর্পণ করবেন।
এসব দলের মধ্যে রয়েছে পূর্ববাংলার সর্বহারা, পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা), নিউ পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি ও কাদামাটি। আত্মসমর্পণকারীদের অনেকের বিরুদ্ধে হত্যা, ডাকাতি, বিস্ফোরক ও অস্ত্র মামলা রয়েছে। তারা পুলিশের তালিকাভুক্ত সন্ত্রাসী। আত্মসমর্পণ করলেও তাদের নিয়মিত মামলা চলবে।
আটঘরিয়া এলাকার চরমপন্থী সন্ত্রাসী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, সরকারের এই ভালো উদ্যোগের সুযোগে আলোর পথে আসার সুযোগ পেয়েছি। তাই আন্মসমর্পন করছি।সরকার আমাদের কর্মের সুযোগ করে দিলে ভালো হবে। আতাইকুলা থানার কয়েকজন চরমপন্থী না প্রকাশ করার শর্তে বলেন- আগে ভাবছিলাম এই পথ সঠিক এখন দেখছি এই পথ সঠিক নয়। এই আত্মসমর্পণের মাধ্যমে বাবা মা পরিবার পরিজন নিয়ে সুস্থ জীবন যাপন করব। এরকম সুযোগ করে দেয়ায় সরকারকে ধন্যবাদ দিতেই হয়। এই পথে আর ফিরবো না।
পুলিশ সুপার শেখ রফিকুল ইসলাম জানান- উত্তর ও দক্ষিণাঞ্চলের চরমপন্থী দলগুলো নির্মূল না হলেও নেতৃত্বশূন্য ও কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। এছাড়া, পরিবার বিচ্ছিন্ন ও অন্ধকার জগতের অপরাধীরা সমাজে সুস্থ স্বাভাবিকভাবে বাঁচতে পুলিশের সাহায্য চেয়েছে। তাদেরকে স্বাভাবিক জীবনে ফেরাতে আমাদের পক্ষ থেকে সর্বোচ্চ সহযোগিতা দেওয়া হবে।
পুলিশ সুপার আর বলেন, “আত্মসমর্পণের পর তাদের আত্মনির্ভরশীল করতে সরকারিভাবে আর্থিক প্রণোদনাসহ পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হবে। আবারও তারা অপরাধে যুক্ত হচ্ছে কিনা, সে ব্যাপারে নজরদারিও থাকবে।
অনুষ্ঠানে অংশ নিতে ৮ এপ্রিল আত্মসমর্পণকারী চরমপন্থি সদস্যদের স্ব-স্ব জেলা থেকে কঠোর নিরাপত্তার মধ্যে দিয়ে পাবনায় নিয়ে আসা হবে। এজন্য পাবনায় বাড়তি নিরাপত্তামূলক ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। র‌্যাব, পুলিশসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর প্রায় ৫শ’ সদস্য মোতায়েন থাকবে।
সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শামসুল হক টুকু ববিবার দুপুরে পাবনা প্রেস ক্লাবে এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন- চরমপন্থীদের বাইবে যারা সন্ত্রাসী কর্মকান্ডে লিপ্ত তারাএকই সুযোগ পাবে। সরকারের স্বক্ষমতা অনুযায়ী স্বাভাবিক জীবন যাপন করতে যা প্রযোজন সেটা করা হবে।
পাবনা জেলা পুলিশের তথ্য অনুযায়ী, ২০০০ সালের পর থেকে এ পর্যন্ত চরমপন্থী দলগুলোর অন্তকোন্দল ও পুলিশী অভিযানে মারা গেছে ১৯৭ জন। আগামী ৯ এপ্রিল পাবনায় বাবলু প্রামাণিকের নেতৃত্বে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টি (লাল পতাকা) এবং ইউসুফ ফকিরের নেতৃত্বে পূর্ব বাংলার সর্বহারা দলের ১৬০ জন চরমপন্থী সদস্যের অস্ত্রসহ আত্মসমর্পণের কথা রয়েছে। এর বাইরেও অনেক সন্ত্রাসী আত্মসমর্পণ করবে।
স্বাধীনতার পর সমাজতন্ত্র প্রতিষ্ঠার নামে পাবনাসহ উত্তর ও দক্ষিণ বঙ্গের বিভিন্ন জেলায় সশস্ত্র তৎপরতা শুরু করে পূর্ব বাংলা কমিউনিস্ট পার্টি। তারা ধনীর সম্পদ গরীবের মাঝে বিলিয়ে দেয়ার কথা বলে এলাকায় হত্যা, ডাকাতি ও লুণ্ঠনের রাজত্ব কায়েম করে।
আশির দশক থেকে পূর্ববাংলা কমিউনিস্ট পার্টির সদস্যরা বিভিন্ন দল ও উপদলে বিভক্ত হয়ে দুর্গম চরাঞ্চলে ঘাঁটি গেড়ে এ অঞ্চলকে সন্ত্রাসের অভয়ারণ্যে পরিণত করে। কিন্তু যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়নের কারণে চরমপন্থীরা এখন আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সহজেই ধরা পড়ে যাচ্ছে।
২০ বছর আগে ১৯৯৯ সালে তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী মোহাম্মদ নাসিমের কাছে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন জেলার চার শতাধিক চরমপন্থি সদস্য আত্মসমর্পণ করেছিল। সেই সময় তাদের আনসার বাহিনীতে বিশেষ আনসার হিসেবে নিয়োগ দিয়ে পুনর্বাসিত করা হয়।