হাঁসের ডিম বিক্রি করে চর চটকিমারার যুবকরা স্বাবলম্বী

448
dav

ভোলা, ৩০ মার্চ, ২০১৯ (বাসস) : জেলা সদরের বিচ্ছিন্ন চর চটকিমারা গ্রামে ডিম বিক্রি করে স্বাবলম্বী হয়েছেন যুবকরা। ভেদুরিয়া ইউনিয়নের তেতুলিয়া নদী বেষ্টিত চর-চটকিমারায় প্রায় ৩৫ জন যুবক হাঁস পালনের মাধ্যমে ডিম বিক্রি করে অবস্থার পরিবর্তন করেছে। প্রত্যেকে নিজ নিজ উদ্যোগে গড়ে তুলেছেন ছোট-মাঝারি-বৃহৎ হাঁসের খামার। এসব খামারের উৎপাদিত হাজার হাজার ডিম নৌকায় করে নদী পার হয়ে খামারিরা নিয়ে আসে। নদী তীর থেকেই ব্যাপারীরা ডিম কিনে নিয়ে যায়। আবার কেউ কেউ সরাসরি বরিশালসহ বিভিন্ন এলাকায় বিক্রি করে থাকেন। প্রায় সবারই ৩’শ থেকে হাজার হাঁস রয়েছে। এছাড়া পারিবারিকভাবেও এখানে প্রচুর হাঁস প্রতিপালন করা হয়।
ভেদুরিয়া ইউনিয়নের বিচ্ছিন্ন চর চটকিমারায় খেয়া নৌকার মাধ্যমে ১০ মিনিটের তেতুলিয় নদী পাড়ি দিয়ে যেতে হয়। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, প্রায় দেড় হাজার মানুষের বসবাস এ গ্রামে। প্রচুর বিলাঞ্চল ও সমতল জমি থাকায় এখানে হাঁস প্রতিপালন অনেকটাই সহজ। চারদিকে নদী-খাল থাকায় প্রচুর শামুক পাওয়া যায় এখানে। যা হাঁেসর প্রধান খাদ্য। এখানে হাঁস পালন করে অনেক যুবকই বেকারত্ব দূর করেছেন। ভাগ্য বদলেছে এখানকার বহু পরিবারের। বসত ঘরের পাশে নেট (জাল) দিয়ে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার। এসব খামারের কাজে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও অংশ গ্রহণ করছে।
কথা হয় হাঁস খামারী মো: আলাউদ্দিন মিয়া (৩৬) এর সঙ্গে। তিনি গত ১০ বছরেরও বেশি সময় ধরে হাঁস পালন করে আসছেন। বসত ঘরের পাশের জমিতে গড়ে তুলেছেন হাঁসের খামার। প্রথমে ২’শ হাঁস দিয়ে শুরু করলেও বর্তমানে তার প্রায় ৭’শ হাঁস রয়েছে। প্রতিদিন সকালে এসব হাঁস চরের নদী ও খালে চড়ানো হয়।
তিনি বলেন, দৈনিক প্রায় ৫’শ ডিম হয় তার খামারে। ১’শ ডিম ৯’শ টাকা মূল্য হারে তার ৪হাজার ৫’শ টাকার ডিম বিক্রি হয় প্রতিদিন। অন্যান্য খরচ বাদ দিয়ে তার ২ থেকে আড়াই হাজার টাকা লাভ হয়।
মো: মোসলেউদ্দিন (৩০) বাসস’কে বলেন, আগে তিনি কৃষি কাজ করতেন। তার এক বন্ধুর ডিম বিক্রিতে লাভ দেখে গত ৫ বছর ধরে হাঁস পালন শুরু করেছেন। বর্তমানে তার ৬’শ হাঁস রয়েছে। দৈনিক প্রায় সাড়ে ৪’শ ডিম হয় তার খামারে। প্রতি ৩ থেকে ৪দিন পর পর এসব ডিম সরাসরি নৌ পথে বরিশালের বাজারে বিক্রি করে থাকেন তিনি।
মোসলেউদ্দিন বলেন, প্রতি ৩ মাস পর পর এসব হাঁসকে ভ্যাক্সিন দেয়া হয়। ফলে হাঁসের রোগ বালাই তেমন হয়না। বছরে ডিম বিক্রি করে ৪ থেকে ৫ লাখ টাকা আয় তার। এর পাশাপাশি তিনি কৃষি কাজ করেন।
ইউসুব জমাদ্দার (৩৩), জসিমউদ্দিন (৩০), আব্দুল হাই (৩৫) বলেন, হাঁস পালনে তেমন কষ্ট হয়না বা বাড়তি লোক রাখারও দরকার পড়েনা। প্রত্যেক খামারি নিজেরাই এসব হাঁস লালন করে থাকেন। বর্তমানে ডিম বিক্রি করে তারা ভালো আছেন।
নৌকায় করে ডিম নিয়ে খেয়া পাড়ি দিয়ে ভেদুরিয়া এসেছেন মো: রুবেল কাজি (২৬) ও শহিদুল ইসলাম (২৪)। তারা ৪ হাজার ডিম এনেছেন বিক্রির জন্য। নদী তীর থেকেই ব্যাপারী কিনে রাখছেন। তারা বলেন, বর্তমান বাজারে ফার্মের ডিমের চেয়ে হাঁসের ডিমের চাহিদা অনেক বেশি। ডিম উৎপাদনে পরিশ্রম ও খরচ তুলনামূলক অনেক কম। তাই অনেকেই এ পেশায় আগ্রহ দেখাচ্ছে।
ডিমের ব্যাপারী মো: সোলায়মান পাটোয়ারী বাসস’কে জানান, দেশী মুরগির ডিম এখন পাওয়া যায়না বল্লেই চলে। লেয়ার মুরগির ডিমের চেয়ে সোনালী মুরগির ডিমের চাহিদা বেশি। তবে বেশি রয়েছে এসব হাঁসের ডিমের চাহিদা। কারণ হাঁসের ডিম আকারেও বড়। তিনি বলেন, এসব ডিম স্থানীয় বাজারসহ শহরের বিভিন্ন দোকান ও বাজারে বিক্রি করা হয়। কখোনো আবার স্বরুপকাঠীসহ অন্যান্য জেলায় ডিম বিক্রি হয় বলে জানান তিনি।
ডিম বিক্রেতা রুবেল কাজি জানালেন আরো চমৎকার তথ্য। এখন চৈত্র মাস। চরের বিশাল ভূমিতে হাস পালন করা গেলেও বর্ষা মৌসুমে আর হাঁস চড়ানো যায়না। তখন সব খামারিরা এখান থেকে হাঁস নিয়ে চরের বাইরে অন্যত্র (সুস্ক) স্থানে নিয়ে যান। বিশেষ করে আষাঢ়, শ্রাবন, ভাদ্র এ তিন মাস চরাঞ্চল পানির নিচে তলিয়ে যায়। তাই তখন খামারিরা অনেকটা যাযাবরের মতন বিভিন্ন স্থানে হাঁস চড়ান।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা (ভারপ্রাপ্ত) ডা. দীনেশ চন্দ্র মজুমদার বাসস’কে বলেন, চর চটকিমারা গ্রামে সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক পরিবেশে যুবকরা হাঁস পালন করে ডিম বিক্রির মাধ্যমে বেকারত্ব দূর করেছে। এটি অবশ্যই একটি ভালো উদ্যোগ। এ চরে হাঁসের যে পরিমাণ খাদ্যের প্রয়োজন তার মধ্যে ৩ ভাগের ২ ভাগই প্রকৃতি থেকে পাওয়া যায়। তাই এ ক্ষেত্রে অন্যান্য খামারির চেয়ে এখানকার খামারিরা অধিক লাভবান হন। আর ডিম এমন একটা খাদ্য যার চাহিদা সব সময় বেশি থাকে।
তিনি আরো বলেন, জেলায় সব মিলিয়ে ১ দিন থেকে প্রাপ্ত বয়স্ক পর্যন্ত ২০ লাখ ৭৩ হাজার ৫০১টি হাঁস রয়েছে। এসব হাঁস থেকে দৈনিক প্রায় পৌনে ২ লাখ ডিম উৎপাদন হয়। প্রাণিসম্পদ অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে হাঁস পালনকারীদের প্রশিক্ষণ, ভ্যাক্সিনসহ সব ধরনের পরামর্শ সেবা দেওয়া হয়ে থাকে বলে জানান তিনি।